২১শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৭শে সফর, ১৪৪৭ হিজরি

ধর্ষণ এক অব্যক্ত শোক, সমাজের অন্ধকার গহ্বরে বিধ্বস্ত নারীর আত্মসম্মান

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান:

ধর্ষণ—এই একটি শব্দ, যা আজকাল আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যেখানে পা রাখি, সেখানেই আমরা এই নিষ্ঠুর অপরাধের কথা শুনতে পাই। শহর, গ্রাম, প্রত্যন্ত অঞ্চল—কোনো স্থানই আজকে নিরাপদ নয়। যেন, প্রতিটি কোণায় একটি অদৃশ্য আতঙ্ক, একটি ভয়, এক অনবরত থাবা। নারী, শিশু, এমনকি বৃদ্ধারাও আর কোথাও নিজেদের নিরাপদ মনে করেন না। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি আজ আমাদের কাছে এক অশ্রাব্য আঘাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনের সংবাদপত্র খুললেই ধর্ষণের খবর—একদিকে নারীর বেদনা, অন্যদিকে সমাজের মুখোশহীন অন্ধকার।
এটি শুধু এক দেশের সমস্যা নয়, বরং পৃথিবীর প্রতিটি সমাজে একটি সামাজিক ব্যাধি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে প্রায় ৫,৪০০ ধর্ষণের ঘটনা পত্রিকায় উঠে এসেছে, তবে বাস্তবে এর সংখ্যা আরও বেশি। প্রতিদিনের ঘটনা, পরবর্তী দিনের শোক—এক ঘুর্ণিপথে চলা ঘটনা। কোথাও না কোথাও এক নারী তার শান্তিপূর্ণ জীবন, তার নির্ভরযোগ্যতার ভিত্তি হারিয়ে ফেলছে। স্কুলের ছাত্রী, গৃহবধূ, কর্মজীবী নারী, শিশু—ধর্ষণের হাত থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কেন এমন হচ্ছে? কেন ধর্ষণকারীরা বারবার অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়? তাদের শাস্তি হচ্ছে না কেন? সমাজে এমন কি অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে অপরাধীরা কোনো ভয় ছাড়াই তাদের ভয়ানক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে? এর পিছনে রয়েছে এমন কিছু কারণ, যার সঙ্গে সমাজের অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা যুক্ত। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান সমাজে এতটাই অবহেলিত হয়ে গেছে, যে এটি এক ধরনের ‘স্বাভাবিকতা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজকের সমাজে নারীরা যেন হয়ে পড়েছেন এক প্রকার খেলনা—যাদের শরীরের প্রতি পুরুষদের তাড়না কোনো বাধা ছাড়াই প্রবাহিত হয়। তারা হেনস্থা হন, তাদের সম্ভ্রম ছিনতাই হয়, এবং সেই সাথে তারা মানসিকভাবে দুঃখিত হয়ে জীবনের পথ হারিয়ে ফেলেন। দেশে আইন থাকলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না, ধর্ষণের পর অপরাধীরা শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যায়।
এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ হলো আমাদের সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা এবং শাস্তি কম। আমাদের দেশের নারীরা এখনো সেই ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মধ্যে কাটাচ্ছেন, যেখানে তারা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে নিজেকে বঞ্চিত। যতদিন অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা না হবে, ততদিন এই হিংস্রতার শিকার আরও বেশি হবে।

“পিরিয়ড মেয়েদেরকে কিছুদিনের জন্য অসুস্থ করে,
ধর্ষণ মেয়েদেরকে সারাজীবনের জন্য স্তব্ধ করে দেয়।”

এই এক বাক্যে ধর্ষণের ভয়াবহতা ফুটে ওঠে। ধর্ষণের পরিণতি শুধু শারীরিক নয়, এটি জীবনের সার্বিক পরিণতিতে গভীর ছাপ ফেলে। ধর্ষণ কেবল নারীর দেহকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, তার মনও আহত হয়, তার আত্মবিশ্বাসও ভেঙে পড়ে।
তবুও, আমরা যদি একে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখব এবং কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ না করি, তবে ধর্ষণের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। এই নৃশংস অপরাধের বিরুদ্ধে আমাদের একত্রিত হতে হবে, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, এবং নারীর প্রতি সম্মান ও মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে। কঠোর আইন, দৃঢ় বিচার, ও সামাজিক সচেতনতা-ই আমাদের এই সমস্যার সমাধান।
আমাদের সমাজে ধর্ষণ বন্ধের একমাত্র উপায়, তা হলো সরকার, সমাজ এবং জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ। একমাত্র সুশাসন এবং ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়েই নারীরা তাদের মর্যাদা ফিরে পাবে, এবং সমাজে সম্মানিত জীবনযাপন করতে পারবে।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এটা আমরা আর কতকাল সহ্য করব? একটি নারীর নিরাপত্তা এবং মর্যাদা নিশ্চিত না হলে, সভ্য সমাজের অস্তিত্ব কি সত্যিই অটুট থাকবে?
এটি আমাদের সকলের দায়িত্ব, এক অবিচ্ছেদ্য সমাজ গড়ার যেখানে ধর্ষণের মতো অপরাধের স্থান থাকবে না, এবং নারীরা পাবেন তাদের স্বীকৃতি ও সম্মান।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top