৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২রা জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

প্লাস্টিক অভিশাপ নাকি আশির্বাদ?

মোঃ সাজেল রানা, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি:

প্লাস্টিক আমাদের জীবনে এমন একটি উপাদান, যা ছাড়া বর্তমান জীবন কল্পনাও করা কঠিন। প্রতিদিনই আমরা নানা ধরণের প্লাস্টিক ব্যবহার করি, সকাল থেকে সন্ধ্যা, ঘরবাড়ি থেকে বাজার-দোকান, সড়ক থেকে আকাশ – সব ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের উপস্থিতি। ১৯০৭ সালে বেলজিয়ান বিজ্ঞানী লিও হেনড্রিক বেকেল্যান্ড প্রথম প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন। মাত্র ১১০ বছর আগে আবিষ্কৃত এই উপাদান আজ আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। তবে প্লাস্টিকের সুফল এবং কুফল সম্পর্কে আমাদের আরও সচেতন হওয়া দরকার।

সুফল:
প্লাস্টিকের আবিষ্কার মানব জীবনে অনেক সুবিধা নিয়ে এসেছে। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুফল হলো:
1. সহজ এবং টেকসই: প্লাস্টিক অনেক হালকা, সাশ্রয়ী, এবং বিভিন্ন পরিবেশে টেকসই হতে পারে। এটি অত্যন্ত সহজে বিভিন্ন রকমের আকারে রূপান্তরিত করা যায়।
2. স্বাস্থ্য খাতে অবদান: চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের নানা উপাদান ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন সিরিঞ্জ, ইঞ্জেকশন, ক্যাটেটার এবং অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী, যা জীবনের জন্য অপরিহার্য।
3. টেকনোলজি এবং নির্মাণ শিল্পে ব্যবহার: প্লাস্টিকের আধুনিক ব্যবহার প্রযুক্তির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যেমন, গাড়ির যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রনিক্স, এবং নির্মাণ শিল্পে বিভিন্ন প্লাস্টিকের উপাদান ব্যবহৃত হয়।

কুফল:
যদিও প্লাস্টিক আমাদের জীবনে অনেক সুবিধা এনেছে, তবে এর কুফলও অনেক গুরুতর। এর মধ্যে অন্যতম কিছু কুফল হলো:1. দীর্ঘস্থায়ী ধ্বংস: প্লাস্টিক সহজে পচনশীল নয়। এটি মাটিতে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী থাকে, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। প্লাস্টিকের বর্জ্য পরিবেশে জমে থাকতে থাকতে একসময় মাটি ও পানি দূষিত করে।
2. কৃষিতে ক্ষতি: প্লাস্টিকের বর্জ্য জমির মধ্যে মিশে কৃষি জমির উর্বরতা কমিয়ে দেয়। এটি কৃষিকাজের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হতে পারে, কারণ প্লাস্টিক মাটিতে থাকা জীবাণু ও খনিজ পদার্থের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
3. খাদ্য দ্রব্যে সংক্রমণ: প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণিকা শস্য এবং খাদ্য দ্রব্যের সঙ্গে মিশে প্রাণীজগতের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। যা মানবদেহে প্রবাহিত হয়ে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন ক্যান্সার, প্রজনন সমস্যা, এবং নানা জটিল রোগ।

প্লাস্টিক একদিকে আমাদের জীবনের প্রয়োজনীয় উপাদান, তবে অপর দিকে এটি প্রকৃতিতে বিপদ ডেকে আনে। আমাদের উচিত প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো এবং এটি পুনঃব্যবহার করার উপায় খোঁজা। পরিবেশ ও মানবতার ক্ষতির থেকে রক্ষা পেতে, সবাইকে প্লাস্টিকের সঠিক ব্যবহারে সচেতন হতে হবে এবং তার প্রতিস্থাপনযোগ্য বিকল্প ব্যবহার করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
প্লাস্টিক রি সাইকেল: পরিবেশ রক্ষায় আমাদের দায়িত্ব

প্লাস্টিক আজকের দিনেও আমাদের জীবনযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এর বেহিসাবি ব্যবহার পরিবেশের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠেছে। তাই আমরা যদি প্লাস্টিকের সঠিক ব্যবহারের দিকে নজর না দিই, তাহলে এর কুফল দীর্ঘমেয়াদে আরও বাড়তে পারে। কিন্তু, প্লাস্টিকের ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট ক্ষতির পরিমাণ কমাতে আমরা প্লাস্টিক রি সাইকেল (পুনর্ব্যবহার) এর মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা করতে পারি। এই রি সাইকেল প্রক্রিয়া শুধুমাত্র আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে না, বরং এটি প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের একটি বড় উপায়।

প্লাস্টিক রি সাইকেলের উপকারিতা:

1. প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ: প্লাস্টিক রি সাইকেল করলে নতুন প্লাস্টিক উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন তেল ও গ্যাসের ব্যবহার কমে যায়। এটি পরিবেশে দূষণ কমায় এবং পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ শক্তির ব্যয়ও হ্রাস করে।

2. যত্নে পরিবেশ রক্ষা: প্লাস্টিকের বর্জ্য পুনঃব্যবহার করার মাধ্যমে আমরা প্লাস্টিকের দূষণ কমাতে সক্ষম। এটি আমাদের নদী, সমুদ্র এবং বায়ুর মধ্যে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর উপাদান কমাতে সাহায্য করবে।

3. নতুন পণ্য তৈরি: পুনঃব্যবহৃত প্লাস্টিক থেকে নতুন পণ্য তৈরি করা সম্ভব। প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগ, খালি প্যাকেট ইত্যাদি থেকে তৈরি করা যায় অনেক ধরনের পণ্য, যেমন আসবাবপত্র, পোশাক, এবং গৃহস্থালির নানা জিনিস।4. বিদ্যুৎ এবং শক্তির সাশ্রয়: রি সাইকেল প্রক্রিয়ায় পুরানো প্লাস্টিকের পণ্য নতুনভাবে ব্যবহারের উপযোগী হয়, ফলে নতুন প্লাস্টিক উৎপাদনে খরচ কমে যায় এবং শক্তির সাশ্রয় হয়।

5. অর্থনৈতিক উপকারিতা: রি সাইকেল প্রক্রিয়া নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে প্লাস্টিক পুনঃপ্রসেসিং শিল্পে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়।

প্লাস্টিক রি সাইকেল সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো

প্লাস্টিক রি সাইকেলের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা করতে হলে আমাদের সচেতনতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। এই সচেতনতার জন্য আমরা নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নিতে পারি:

1. শিক্ষা এবং প্রচারণা: স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্লাস্টিক রি সাইকেলের গুরুত্ব নিয়ে শিক্ষামূলক কার্যক্রম চালানো উচিত। স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্লাস্টিক রি সাইকেল সম্পর্কিত প্রচারণা চালানো দরকার।

2. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ: সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্লাস্টিক পুনঃব্যবহারের জন্য কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। একই সঙ্গে প্লাস্টিক রি সাইকেল প্রকল্পগুলোর জন্য তহবিল বরাদ্দ করা যেতে পারে।

3. ভোক্তাদের উৎসাহিত করা: আমরা যদি প্লাস্টিকের পণ্য কেনার সময় সঠিকভাবে রি সাইকেল করি, তবে তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অংশ হতে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠানও রি সাইকেল প্লাস্টিকের পণ্য বিক্রি করে, যার মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
4. বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো: এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্লাস্টিক রি সাইকেল প্রক্রিয়া সহজ ও কার্যকরী করা সম্ভব।

প্লাস্টিক রি সাইকেল শুধু পরিবেশ রক্ষার একটি উপায় নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। যদি আমরা সকলেই সচেতন হই এবং প্লাস্টিকের ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করি, তবে তা আমাদের পরিবেশের জন্য একটি বিশাল উপকারে আসবে। আমাদের উচিত প্লাস্টিক রি সাইকেলের মাধ্যমে পৃথিবীকে নিরাপদ ও পরিষ্কার রাখা, যাতে আগামী প্রজন্মও সুস্থ পরিবেশে জীবনযাপন করতে পারে।

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

এই বিভাগের আরও খবর

উজিরপুরে সিআরএসএস ও ওয়ার্ল্ড ভিশনের উদ্যোগে পুষ্টি মেলার

মোঃ মাহফুজুর রহমান মাসুম, উজিরপুর প্রতিনিধিঃ বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার উজিরপুর সিআরএসএস ও ওয়ার্ল্ড ভিশনের উদ্যোগে হতদরিদ্র অপুষ্ট শিশুদের পুষ্টি মান উন্নয়নের উদ্দেশ্য শিশুর মা

তালায় উপজেলার উন্নয়নকল্পে সাংবাদিক ও সুধীজনদের সাথে ইউএনও’র মতবিনিময় সভা

কাজী রিয়াজ, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: তালা উপজেলার উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে সাংবাদিক ও সুধীজনদের সাথে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার (২৯

মজু কোম্পানির বেয়াই কোরবান আলী, এলাকায় আবারও অপরাধের রাজত্ব

আসগর সালেহী, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ভূজপুর থানার হেয়াকো সিকদারখীল এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী, ইয়াবা সম্রাট, বনখেকো ও চাঁদাবাজ কোরবান আলী ওরফে কোরবান আলী সওদাগর

বাংলাদেশ ছাত্র হিযবুল্লাহ দারুননাজাত তাখসীসির সাপ্তাহিক জলসা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান

আব্দুল মাবুদ মোহাম্মদ ইউসুফ, নরসিংদী প্রতিনিধিঃ “শিশুর পিতা ঘুমিয়ে আছে সব শিশুরই অন্তরে”—এই গভীর অন্তর্দৃষ্টি-সম্পন্ন বাণীকে উপজীব্য করে বাংলাদেশ ছাত্র হিযবুল্লাহ, দারুননাজাত তাখসীসি মাদ্রাসা শাখার

Scroll to Top