৯ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১১ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

ঘাতক বদলায়, নির্দেশক একটাই

লেখক,শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর

গাজার ভোর এখন আর সূর্যোদয়ের প্রতীক নয়, বরং এক আগুনঝরা আর্তনাদ। প্রতিটি নতুন দিন শুরু হয় মৃত্যুর গণনায়, প্রতিটি রাত শেষ হয় শিশুর কান্নায়। ধ্বংসস্তূপের নিচে চেপে থাকা কেবল পাথর নয়—সেখানে চাপা পড়ে আছে মানবতা, ন্যায্যতা, আর এক সভ্যতার মুখোশ। এবং এই হত্যার দৃশ্যপটে যতই ইসরায়েলের নাম লেখা থাকুক, নির্দেশটা ঠিকই আসে ওয়াশিংটনের কোনো নির্লিপ্ত অফিসঘর থেকে। ঘাতক বদলায়, কিন্তু নির্দেশক—একটাই।

ইসরায়েল যে হত্যা করে, তা আমরা দেখি। কিন্তু সে কেন করে, কে করায়—সেই উত্তর অদৃশ্য হয়ে যায় কূটনীতির ভদ্রভাষায়। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা যুক্তরাষ্ট্র নিজের হাতে রক্ত লাগায় না, সে ছুরি তুলে দেয়, অস্ত্র পাঠায়, অর্থ ঢালে। আর তারপর চোখের সামনে মানবতার হত্যাযজ্ঞ দেখে নিঃশব্দে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন নীতিবোধ তার জন্য একটি ফাইল, যেটি সুবিধা অনুযায়ী খোলা বা বন্ধ করা যায়।

ইসরায়েলের জন্মই হয়েছিল এক ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কোলে। মধ্যপ্রাচ্যের বুকে মার্কিন আধিপত্য স্থাপনের জন্য এই রাষ্ট্রকে বানানো হয়েছিল এক অগ্রবর্তী যুদ্ধঘাঁটি। ১৯৪৮ সালে যে ‘বসতি রাষ্ট্র’কে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল জাতিসংঘ, সে তখন থেকেই ছিল ওয়াশিংটনের পুতুল। আজ সেই পুতুলই গজিয়ে তুলেছে এক বিশাল সামরিক দানব, যার প্রত্যেকটি হামলার পেছনে জ্বালানি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। টাকা দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে, আর সবচেয়ে বড় কথা—নীরব সম্মতিতে।

গাজায় যখন ফসফরাস বোমা ফেটে পড়ে, তখন সেই আগুনে শুধু শিশু নয়, পুড়ে যায় আমেরিকার মুখোশও। গণতন্ত্রের যে মুখ তারা দেখায়, তা গলে পড়ে যুদ্ধের উত্তাপে। “আত্মরক্ষা” শব্দটি তারা এমনভাবে প্রয়োগ করে, যেন শিশুদের হত্যা হয়ে যায় বৈধ, যেন হাসপাতালের ধ্বংস হয়ে যায় আত্মরক্ষার কৌশল। অথচ প্রতিটি হামলার আগে যেসব বোমা উড়ে আসে, তার গায়ে থাকে মার্কিন ট্যাগ। প্রতিটি ভেটো, প্রতিটি মিডিয়া স্পিন, প্রতিটি নীরবতা—তাদের সম্মতি নির্দেশ করে।

যারা আজ শুধু ইসরায়েলকে দোষ দেয়, তারা যেন জানে—এই হত্যাকাণ্ডে দোষ একক নয়। হত্যাকারীর পেছনে থাকে উস্কানিদাতা, আর সেই উস্কানিদাতাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ সে নিজে রক্ত ছোয় না, শুধু ছুরি চালে, তারপর সাদা পাঞ্জাবিতে নিঃসংশয়ে সভ্যতার বয়ান পড়ে।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে পাওয়া যায়—আজকের চিত্র নতুন নয়। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া—যেখানেই যুক্তরাষ্ট্র তার ‘শান্তি মিশন’ নিয়ে গেছে, সেখানে রেখে এসেছে ধ্বংসের ধোঁয়া, বিদীর্ণ শবদেহ, আর এক লুপ্তপ্রায় স্বাধীনতা। তারা যুদ্ধ করে না, যুদ্ধ ঘটায়। তারা আগুন লাগায়, তারপর পানি নিয়ে দাঁড়ায় ক্যামেরার সামনে। ঠিক যেমন এখন গাজার সামনে দাঁড়িয়ে বলছে—‘আমরা সহিংসতা থামাতে চাই’, অথচ পেছনে চালান যাচ্ছে যুদ্ধবিমান।

এই ভণ্ডামির রাজনীতিই আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য। তারা গণতন্ত্র রপ্তানি করে বুলেটবক্সে, মানবতা শেখায় ড্রোনের রাডারে, আর সংবেদনশীলতার সংজ্ঞা ঠিক করে নিজেদের স্বার্থে। তাই গাজার মৃত্যু তাদের কাছে নিছক একটি কোল্যাটারাল ড্যামেজ, একটি সামরিক পরিসংখ্যান মাত্র।

প্রশ্ন হলো—এই চিত্র সবাই জানে, তবু কেন চুপ? কারণ যারা কথা বলবে, তাদের গলায় জড়ানো আছে অর্থনৈতিক দাসত্বের দড়ি, কূটনৈতিক নির্লজ্জতার শেকল। তারা জানে, মুখ খুললে বন্ধ হবে অনুদান, সরবে দাঁড়ালে হারাবে সম্পর্ক। তাই গাজার মৃত্যু দেখে তারা চোখ ফেরায়, যেন সত্যকে না দেখলেই সত্য হারিয়ে যাবে।

কিন্তু সত্য নিজেই লিখে রাখে ইতিহাস। আজ যারা চুপ, কাল তাদের নাম লেখা থাকবে সেই তালিকায়—যারা দেখেছিল, জানত, কিন্তু ভয় পেয়েছিল। ইসরায়েল হয়তো সাময়িকভাবে ঘাতক, কাল হয়তো আরেকজন আসবে। কিন্তু যে নির্দেশ দেয়, যে পরিকল্পনা আঁকে, যে লাভ গোনে রক্তের বিনিময়ে—সেই নির্দেশক বদলায় না।

এখন সময় সত্য বলার। সময় এসেছে এই ভদ্রতা ছিঁড়ে ফেলার, এই মুখোশ খুলে দেখার—কে আসলে সভ্যতা আর কে রক্তমাখা চক্রান্তকারী। কারণ যারা চুপ থাকে, তারাও এক ধরনের অপরাধী। আর ইতিহাস তাদেরও বিচার করে—অবশ্যই করে।

 

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

এই বিভাগের আরও খবর

আল্লাহর ভালোবাসা—হৃদয়ের আকাশ জুড়ে অনন্ত শান্তির প্রভা

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান যখন পৃথিবীর সমস্ত শব্দ স্তব্ধ হয়ে আসে, যখন সব আশা ধূসর ধুলোয় মিশে যায়—তখনো এক অনন্ত আশ্রয়, এক চিরন্তন ভালোবাসা

৫ মে: শাপলা চত্বরের সেই রক্তাক্ত রাতের স্মৃতি

আজ ঐতিহাসিক ৫ মে। ক্যালেন্ডারে অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও বদলায়নি সেই ‘ভয়াল রাতের স্মৃতি’। ২০১৩ সালের এই দিন, ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে ইতিহাসের ‘নির্মমতম গণহত্যা’

আবেগের কফিনে গাঁথা এক জীবনের কবরগাথা

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান সে ছিল স্বপ্নবতী এক তরুণী—চেহারায় মাধুর্য, মননে দীপ্তি। চোখে ছিল স্বপ্ন, হৃদয়ে ছিল নির্মল আকাঙ্ক্ষা। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়ার সময় একদিন স্বাভাবিকভাবেই

ঘামে লেখা গৌরবনামা ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা ও মানবতার দৃষ্টিভঙ্গি

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান সকাল যখন দিগন্তে আলো ছড়িয়ে দেয়, তখন প্রথম যে শব্দ ভেসে আসে, তা হলো হাতুড়ির শব্দ, করাতের ঘর্ষণ কিংবা জমিনে

Scroll to Top