১৩ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৮ই মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় একমাত্র পথ ইসলাম

লেখক: মাওলানা আসগর সালেহী

মে দিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
মে দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় প্রতি বছর ১ মে। এর সূচনা ১৮৮৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে, যখন শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার দাবিতে আন্দোলনে নামে। ‘হে মার্কেট’ আন্দোলনের নামে পরিচিত এই গণআন্দোলনে অনেক শ্রমিক শহীদ হন, আর এ থেকেই উৎপত্তি হয় “মে দিবসের”।

এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে। দিনটি কেবল একটি শ্রমিক দিবস নয়, এটি শোষণবিরোধী সংগ্রামের প্রতীকও।

মে দিবস সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি:
ইসলামে মে দিবস পালনের মতো নির্দিষ্ট কোনো দিন বা তারিখ নেই, তবে শ্রমিকের অধিকার, ন্যায্য মজুরি, শ্রমের মর্যাদা, এবং নিয়োগকর্তার নৈতিকতা নিয়ে ইসলাম অত্যন্ত স্পষ্ট ও ন্যায়সঙ্গত দিকনির্দেশনা দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
তোমাদের অধীনস্থদের তাদের অধিকার দিয়ে দাও, এবং তাদের ওপর এমন কাজ চাপিও না যা তারা সামাল দিতে পারে না।
-সহিহ বুখারী।

ইসলাম শুধু শ্রমিকদের নয়, মালিকদের প্রতিও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানায়। ইসলাম চায় না যেন কেউ শোষিত হয়, আবার যেন অন্য কেউ অবিচার করে।

বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদের আলোকে শ্রমের মর্যাদা:
প্রতিটি প্রধান ধর্মই শ্রমকে সম্মানিত করেছে। খ্রিস্ট ধর্মে যীশু খ্রিস্ট নিজে ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি। হিন্দু ধর্মে শ্রমকে ‘কর্ম’ হিসেবে দেখা হয়, যা পুনর্জন্ম বা মুক্তির পথ নির্ধারণ করে। বৌদ্ধ ধর্মে ‘সাম্য’ ও ‘উপকারী কর্ম’ গুরুত্ব পায়।

কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের মতবাদে শ্রমিক শ্রেণিকে বিপ্লবের হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়, যেখানে পুঁজি বা মালিক শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত উপায় বলা হয়।

ইসলামের আলোকে শ্রমের মর্যাদা:
ইসলামে শ্রমকে শুধু জীবিকা নয়, ইবাদতের পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। রাসূল (স.) নিজ হাতে খেজুর বাগান তৈরি করেছেন, খাদ কেটেছেন, এবং কঠোর পরিশ্রমকে সম্মান জানিয়েছেন।

নিজ হাতে উপার্জন করা খাদ্যই সর্বোত্তম।
-সুনানে ইবনু মাজাহ।

এক হাদীসে এসেছে, এক সাহাবী রাসূল (স.) এর কাছে এসে ভিক্ষা চাইলে তিনি বলেন, “তুমি বাজারে গিয়ে রশি কিনে কাঠ কেটে এনে বিক্রি করো—তাহলে তোমার মর্যাদা থাকবে, ভিক্ষা নয়।” এ থেকে বোঝা যায়, ইসলাম আত্মমর্যাদা রক্ষায় শ্রমকে উৎসাহ দেয়।

শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামের বিকল্প নাই:
বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন শ্রম আইন, মানবাধিকার দলিল ইত্যাদি আজো ন্যায্য মজুরি, শ্রমিকের সুরক্ষা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। পুঁজিবাদ শোষণকে প্রশ্রয় দেয়, সমাজতন্ত্র ব্যক্তি স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে—এমন পরিস্থিতিতে কেবল ইসলামই একমাত্র আদর্শ যে এখানে সমতা, দায়িত্ব ও ন্যায়ের ভারসাম্য রক্ষা করে।

ইসলাম বলে, নিয়োগকর্তা যেন শ্রমিকের মজুরি ঘাম শুকানোর আগেই দিয়ে দেয়। ইসলাম বলেছে, শ্রমিকদের অধিকার শুধু আইন দিয়ে নয়, তাকওয়া, নৈতিকতা ও আল্লাহভীতির আলোকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। একজন প্রকৃত মুসলিম মালিক কখনোই শ্রমিককে ঠকাতে পারে না, কারণ সে জানে সে একদিন আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করবে।

মে দিবস শুধু একটি স্মারক দিন নয়, এটি শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক। তবে শ্রমিক অধিকার ও মর্যাদার প্রকৃত ব্যাখ্যা এবং কার্যকর পদ্ধতি ইসলামই দিয়েছে। আজকের দিনে প্রয়োজন—ইসলামের আলোকে শ্রমনীতি বাস্তবায়ন করা, যেখানে থাকবে না শোষণ, অবিচার, কিংবা শ্রেণি বৈষম্য। ইসলামের কল্যাণমুখী সমাজব্যবস্থায় মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্ক হবে পরস্পরের দায়িত্বশীলতায় ভরপুর, আর তাতেই গড়ে উঠবে একটি ইনসাফভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র।

লেখক:
মাওলানা আসগর সালেহী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।
ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top