৯ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১১ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ : দক্ষিণ এশিয়ার অনিবার্য বিপর্যয়

ইমতিয়াজ উদ্দিন, জবি প্রতিনিধি

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক চিরকালই উত্তেজনায় ভরপুর ছিল। ভারত ও পাকিস্তানের এই বৈরি সম্পর্ক ক্রমশই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে সেই উত্তেজনা এখন রূপ নিয়েছে সরাসরি সামরিক সংঘাতে। গত মঙ্গলবার (৬ মে, ২০২৫) মধ্যরাতের পর ভারত পাকিস্তানের ছয়টি শহরে একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানও পাল্টা জবাবে ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে। দুপক্ষেই প্রাণহানি ঘটেছে, বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা। দক্ষিণ এশিয়ার আকাশে আবারও যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে যা বিশেষজ্ঞদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে।

একটা কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন। এই যুদ্ধ কিন্তু হঠাৎ করে শুরু হয়নি। দশকের পর দশক ধরে জমে থাকা অবিশ্বাস, রাজনৈতিক উত্তেজনা, সীমান্ত বিরোধ এবং কাশ্মীর ইস্যু- এসবই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আগুনে ঘি ঢেলেছে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ১৯৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধ- প্রতিটি ছিল একেকটি রক্তাক্ত অধ্যায়। সেই ঘটনাগুলোর জের ধরে দুই দেশের সম্পর্কে চূড়ান্ত ফাটল ধরে।

যদিও ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই পারমাণবিক শক্তিধর এবং ‘পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ’ থেকে বরাবরই দূরে থেকেছে, তবুও সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে সেই ভারসাম্য ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সীমান্ত সংঘর্ষ আর কৌশলগত উত্তেজনা প্রায়ই নির্বাচনী কৌশল ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক খেলায় ব্যবহৃত হয়েছে।

এছাড়া পাকিস্তানেও যুদ্ধাবস্থার প্রস্তুতি ও যুদ্ধের আশঙ্কা উসকে তোলা হয়েছে বহুবার, বিশেষত। ইমরান খানের জনপ্রিয়তা ঠেকাতে কিংবা তালেবান বা বেলুচিস্তান বিদ্রোহ সামাল দিতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা পুরনো রীতি রয়েছে। বর্তমান সেনাপ্রধান আসিম মুনিরও সেই পথেই হাঁটছেন বলে অনুমান করা যায়।

তবে যুদ্ধ শুধু একটি কৌশলগত প্রদর্শনী নয়। যুদ্ধ মানে প্রাণহানি, উদ্বাস্তু সংকট, খাদ্য ও ওষুধের অভাব, শরণার্থী স্রোত, ধর্মীয় সংঘাত এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ধ্বংস। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অন্তত ৫৬টি জায়গায় সংঘর্ষ চলছে, যা বিশ্বের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই পটভূমিতে দক্ষিণ এশিয়ার মতো জনবহুল, দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলে একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের শুরু শুধু ধ্বংসই ডেকে আনবে।

উল্লেখ্য, পাকিস্তানের ভূখণ্ড থেকে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা এবং প্রতিবেশী দেশে, বিশেষ করে ভারতে জঙ্গি অনুপ্রবেশ ও হামলার দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে। ভারতের কাশ্মীর অঞ্চলে সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের যোগসাজশ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগ আছে। ইসলামাবাদ বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও বাস্তব পরিস্থিতি, সীমান্ত সংঘর্ষ এবং আটক হওয়া জঙ্গিদের স্বীকারোক্তি থেকে প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তান অনেক সময় সরাসরি নয়, বরং ‘স্টেটের ছায়া’ হয়ে এ ধরনের কার্যক্রমে মদদ দিয়ে এসেছে। এই অস্পষ্ট ও দ্বৈত ভূমিকার ফলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে দীর্ঘস্থায়ী অবিশ্বাস ও উত্তেজনা বিরাজ করে, যা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথে বড় বাধা হিসেবে দেখা দেয়।

দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক পরিপার্শ্ব অনেকাংশেই আন্তঃনির্ভরশীল। ভারত, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, চীন, ইরান সবার সঙ্গেই কোনো না কোনোরূপে ব্যবসা, কূটনীতি বা নিরাপত্তাজনিত স্বার্থ জড়িত। যুদ্ধ শুরু হলে প্রথমেই যে ধাক্কা আসবে, তা পড়বে রপ্তানি বাণিজ্যে, শেয়ারবাজারে, বিনিয়োগে ও জ্বালানিতে। যোগাযোগ ও পরিবহন অচল হয়ে পড়বে, মহাসংকটে পড়বে কৃষি ও উৎপাদন খাত।

বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের একটি উদীয়মান অবস্থান রয়েছে। বিশ্ববাজারে ভারত এখন এক ‘হাব’, যা চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে লাভের জায়গা তৈরি করেছে। এমন সময় একটি যুদ্ধ শুরু হলে ভারতের বৈদেশিক বিনিয়োগ থমকে যাবে, বৈদেশিক বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে এবং অর্থনীতি হোঁচট খাবে। অথচ মোদি সরকার এখনও পর্যন্ত কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করে রেখেছে যা অনেকাংশেই যুদ্ধ ছাড়াই বিজয়ের সমান।

পাকিস্তানের অবস্থা তুলনামূলকভাবে অনেক খারাপ। দেশটি বর্তমানে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। ডন পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পঞ্চাশ বছর আগে পাকিস্তান ছিল একটি প্রগতিশীল অর্থনীতি, এখন আমরা খাদের কিনারে।’ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্তে টিকে থাকা এই রাষ্ট্র কীভাবে একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ চালাবে বা আদৌ পারবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা পুরোপুরি যৌক্তিক।

আরেকটি দিক হলো, যুদ্ধ একবার শুরু হলে তা আর রাজনৈতিক কৌশলের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আমেরিকা-আফগান যুদ্ধ অথবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদেরকে কী দেখিয়েছে? যুদ্ধ শুরু করা সহজ, কিন্তু থামানো অসম্ভব নয়, অন্তত চরম মূল্য বহন ছাড়া তা সম্ভব নয়। যুদ্ধ শুরু করেন একজন নেতা, কিন্তু তার খেসারত দিতে হয় প্রজন্মের পর প্রজন্মকে, অঞ্চলের পর অঞ্চলকে, জাতির পর জাতিকে। কভিড-১৯ এর ধাক্কা এখন পর্যন্ত বিশ্ব সামলাতে পারেনি। এরপরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানান উত্তেজনা বিশ্বমন্দাকে আরো বাড়িয়ে তোলেছে।

ভারত যদি পাকিস্তানকে কোণঠাসা করেই রাখতে চায়, তবে সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হতে পারে কূটনৈতিকভাবে একঘরে করে দেওয়া। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলে সন্ত্রাসের মদদদাতা হিসেবে পরিচিতিকে দৃঢ় করা, সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করা এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বন্ধ রাখা। এসবই যুদ্ধ ছাড়া আরও শক্তিশালী চাপ হিসেবে কাজ করতে পারে।

এখানে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন কিংবা মুসলিম বিশ্ব যে চুপ করে বসে থাকবে তা ভাবা ভুল। পাকিস্তান যদি ইসলামের আবেগকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধকে ধর্মীয় রূপ দেয়, তবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তহবিল বা নৈতিক সমর্থন আসতে পারে। আবার চীন এই উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের প্রভাব বাড়াতে চাইবে তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, মিয়ানমারের মতো দেশেও ভারতবিরোধী মনোভাব গোপনে বাড়ছে যা এই সংকটে কৌশলগত ঝুঁকি আরো বাড়াতে পারে।

যুদ্ধের খরচও এক ভয়াবহ বাস্তবতা। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দুই দশকের যুদ্ধ খরচ দাঁড়িয়েছে দুই দশমিক ৩১ ট্রিলিয়ন ডলার, সুদসহ তা ২০৫০ সালের মধ্যে পৌঁছাবে ছয় দশমিক পাঁচ ট্রিলিয়নে! এই হিসাব কেবল টাকার নয় এটা প্রাণ, সম্পদ, স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যতের হিসাব।

ভারত বা পাকিস্তান, কেউই সেই খরচ বহন করার মতো অবস্থানে নেই। যুদ্ধ শুরু হলে কেউই জিতবে না। বরং বিপর্যস্ত হবে মানবতা। ঘরে ঘরে কান্না শোনা যাবে, উচ্ছেদ হবে লাখো মানুষ, জাতিগুলোর মধ্যে ঘৃণা জন্মাবে। দেশে দেশে অরাজকতা শুরু হয়ে যাবে। সীমান্তের গোলাগুলি ছড়িয়ে পড়বে শহর, গ্রাম ও মানুষের মনে। ধর্মযুদ্ধের ভয়াল ছায়া জাপটে ধরবে সাধারণ মানুষকে। ধ্বংস হবে স্বপ্ন, শিক্ষা, চিকিৎসা, সংস্কৃতি ও শান্তির সম্ভাবনা।

শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে যুদ্ধের মঞ্চে জয়লাভ করেনি কেউই। জয় করেছে কেবল মৃত্যু, বিভাজন ও দারিদ্র্য।

তাই এখন সময় নিজেদের অহংকার, প্রতিশোধ বা নির্বাচনী লভ্যাংশের চিন্তা ছেড়ে বৃহত্তর মানবিক ও কৌশলগত বাস্তবতা উপলব্ধি করার। ইতিহাস বারবার বলেছে যুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু তার ক্ষত থেকে যায় যুগের পর যুগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে জাপানের দুই শহরে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তার ক্ষত আজও সারেনি। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এই যুদ্ধ হবে এক বিপর্যয়ের সূচনা, যা গোটা অঞ্চলের শান্তি, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেবে।

প্রেমের মতো যুদ্ধও শুরুতে উত্তেজনা ও উন্মাদনা তৈরি করে বটে। তবে শেষাবধি তা নিয়ে আসে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি, শোক আর বিভাজন। তাই যুদ্ধের দামামা বাজার আগেই আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে এই যুদ্ধ কার জন্য, কাদের স্বার্থে? আর তার মূল্য কাদের দিতে হবে? এই যুদ্ধ করে ভারত-পাকিস্তান প্রত্যেকে কি আদৌ ভালো থাকতে পারবে? যুদ্ধের ফলে যে ক্ষয়ক্ষতি হবে তা কি আদৌ ভারত-পাকিস্তান সামলাতে পারবে? পাকিস্তান ও ভারতের নেতৃত্ব পরিষদকে এই প্রশ্নগুলোর গভীরে গিয়ে ভাবতে হবে, কূটনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। একই সঙ্গে নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যমের দায়িত্ব যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তির পক্ষে সোচ্চার হওয়া। দেশপ্রেম মানেই অন্ধ আনুগত্য নয়; বরং সত্যিকারের দেশপ্রেম হলো এমন এক বোধ, যা অযথা রক্তপাত ও ধ্বংস ঠেকাতে সাহসের সঙ্গে প্রশ্ন তোলে। যুদ্ধ যেন আর না ঘটে এই চেষ্টায় আমাদের সবার সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া জরুরি। আমরা চাই না দুই দেশের সংঘাতে বিশ্ব আরেকবার পারমাণবিক যুদ্ধের মুখোমুখি হোক।

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

এই বিভাগের আরও খবর

চীনা জে-১০ দিয়ে ভারতীয় রাফালসহ দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিতের দাবি পাকিস্তানের

নিজস্ব প্রতিবেদক: চীনের তৈরি অত্যাধুনিক জে-১০ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ভারতের অন্তত দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে পাকিস্তান। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন কর্মকর্তার

পাকিস্তানের পালটা হামলায় ৪০-৫০ ভারতীয় সেনা নিহতের দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে পাকিস্তানের পালটা অভিযানে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ জন ভারতীয় সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন দেশটির তথ্য ও সম্প্রচার

রাফায়েল যুদ্ধবিমান নিয়ে প্রশ্ন, পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় ভূপাতিত ৩টি

নিজস্ব প্রতিবেদক: কাশ্মীরে পর্যটক হত্যাকাণ্ডের পর চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। এর মাঝেই ফ্রান্সের সঙ্গে ২৬টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করে ভারত।

ভারত সরকারের অনুরোধে ‘মুসলিম’ নামের জনপ্রিয় ইন্সটাগ্রাম পেজ বন্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক: ৬.৭ মিলিয়ন অনুসারীসম্পন্ন ‘মুসলিম’ নামের একটি জনপ্রিয় ইন্সটাগ্রাম পেজ ভারতে বন্ধ করে দিয়েছে মেটা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপি জানায়, ভারত সরকারের আইনি অনুরোধে মেটা

Scroll to Top