আসগর সালেহী, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নের নয়াহাট এবং বাশি মহাজনের হাটের মধ্যবর্তী নাজিরহাট-কাজিরহাট সড়কে হাজারিখীল সংযোগ সড়কের মোড়ে নির্মিত ‘গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবু জাফর চৌধুরী স্মৃতি বিমান চত্বর’ এখন উপজেলার অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন বিকেল হতেই স্থানীয় মানুষজন ও দূরদূরান্তের পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে এই স্থান। বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে থাকে উপচে পড়া ভিড়। দৃষ্টিনন্দন এই স্মৃতি বিমান চত্বরটি স্থানীয়দের কাছে বিনোদন এবং মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস স্মরণের অন্যতম স্থান।
পর্যটকরা এখানে এসে স্মৃতি বিমানের পাশে সেলফি তুলছেন, ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করছেন, যা তাদের জন্য ভ্রমণের বাড়তি আনন্দের উপলক্ষ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবু জাফর চৌধুরী : পরিচিতি ও অবদান
বিমান চত্বরটির নামকরণ করা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) আবু জাফর চৌধুরী, জিডি(পি), পিএসসি-এর নামে।
তিনি ১৯৫৩ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার হারুয়ালছড়ি গ্রামে এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আলহাজ আলী আহমদ চৌধুরী ছিলেন তুরস্কের একজন খ্যাতনামা ধর্মীয় আলেমের শিষ্য।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সেক্টর-০১-এর অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন এলাকায় সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেন। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে প্রথম ব্যাচের ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত ফ্রুনজে সামরিক অ্যাকাডেমিতে বৈমানিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেখান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে দেশে ফিরে আসেন। তিনি একাধারে অপারেশনাল পাইলট, ডিপ্লোমা প্রাপ্ত অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং রুশ-ইংরেজি-রুশ সামরিক দোভাষী হিসেবে প্রশিক্ষিত।
পেশাগত জীবনে তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনাল ও প্রশিক্ষণ ইউনিটের দায়িত্বে ছিলেন। ইরাকে দুই বছর যুদ্ধবিমানের ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া, অপারেশন টাইফুন-এ হেলিকপ্টার পাইলট হিসেবে চট্টগ্রাম পার্বত্যাঞ্চলে বিদ্রোহ দমন অভিযানে অংশ নেন।
অবসরের পর মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। ২০০২ সালে ঢাকা মার্চেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড (ডিএমসিবি)-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার দৃঢ় নেতৃত্বে ৭টি শাখা ও ৬০ লাখ টাকা আমানত নিয়ে শুরু করা এই ব্যাংক বর্তমানে ১৪৭টি শাখা এবং ২০,০০০ কোটি টাকার বার্ষিক লেনদেন পরিচালনা করছে।
সমাজসেবায় তার অবদান-
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর চৌধুরী ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ‘প্রয়াস’সহ নানা সামাজিক সংগঠনে দান, গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ, দরিদ্র রোগীদের সহায়তা, মসজিদ নির্মাণ এবং যাকাত তহবিল গঠনসহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
ধর্মপ্রাণ এই মানুষটি নিজ গ্রামে একটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ নির্মাণ করেছেন, যেখানে শত শত মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করেন।
তিনি বিশ্বাস করেন — সমবায় ভিত্তিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি-
তার সমাজসেবা, উন্নয়ন দর্শন এবং ব্যাংকিং সেক্টরে অনন্য অবদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন অব বিজনেস কর্তৃক বিজ অ্যাওয়ার্ড-২০১৯ সম্মাননা প্রদান করা হয়।
ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র সন্তানের জনক। বর্তমানে এক দৌহিত্রের আদর-স্নেহে দিন কাটাচ্ছেন।
ক্যাপ্টেন (অব.) আবু জাফর চৌধুরীর নামে প্রতিষ্ঠিত এই স্মৃতি বিমান চত্বর এখন শুধু একটি স্মৃতিস্তম্ভ নয়, বরং ফটিকছড়িবাসীর জন্য গৌরব, ইতিহাস আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনের এক অনন্য নিদর্শন।