১৩ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৮ই মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

হজ্জ: হৃদয়ের দিগন্তে আলেয়ার মতো জ্বলে ওঠা আত্মশুদ্ধির আলোকপাঁজর

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

যখন কোটি কোটি হৃদয় এক সুরে উচ্চারণ করে—”লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক”, তখন আকাশ-বাতাসও থমকে দাঁড়ায়। হজ্জ তখন আর শুধু একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা থাকে না; হয়ে ওঠে আত্মার এক অভূতপূর্ব অভিষেক, পবিত্রতার এক অনন্য মহাসম্মিলন। মানুষের জীবনচক্রে এমন কোনো অধ্যায় নেই, যেখানে হজ্জের মত একান্ত ও গভীর আত্মসংশোধনের উপলক্ষ পাওয়া যায়।

ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের শেষতম অথচ সর্বোচ্চ স্তম্ভটি যেন এক অলৌকিক আহ্বান। এই আহ্বান আসে আকাশ পেরিয়ে হৃদয়ের গহীনে, যেখানে মানুষ সমস্ত পরিচয়ের অহংকার ছুঁড়ে ফেলে আত্মবিসর্জনের শুদ্ধতম অবস্থানে পৌঁছে যায়। ধনী-গরিব, রাজা-ভিখারী—সবাই একসঙ্গে দাঁড়ায় কা’বার চৌহদ্দিতে। এক রঙের পোশাক, এক কণ্ঠের ধ্বনি, এক দিকের সেজদাহ—হজ্জ আমাদের শেখায় বিশ্বমানবতার মহাঐক্য।

এই হজ্জের সূচনা সেই ইতিহাসের গভীর থেকে, যেখানে পিতা ইবরাহিম (আ.) তাঁর একমাত্র পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে আল্লাহর আদেশে কুরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। যে কা’বা ঘর তাঁর হাতে নির্মিত, সেই ঘরের চারপাশেই আজ কোটি মানুষের কান্না, তাওয়াফ, প্রার্থনা, নিঃশ্বাস। কত শত বছর পেরিয়ে গেছে, তবুও ইবরাহিম (আ.)-এর সেই আহ্বান—“আসো, তোমার প্রভুর ঘরে”—আজও প্রতিধ্বনিত হয় মিনার বাতাসে, আরাফার স্তব্ধতায়।

হজ্জ মানুষকে শিখিয়ে দেয় কীভাবে নতজানু হতে হয় এক মহান সত্তার সামনে। সেখানে নেই কোনো অহংকার, নেই কোনো রাজকীয়তা, নেই কোনো পার্থিব শ্রেষ্ঠত্ব—আছে কেবল আত্মবিসর্জন, কেবল ফিরে আসা, এক অনবদ্য অনুতাপে নিজের ভুলগুলো মুছে ফেলার ইচ্ছা। হজ্জ যেন একটি জীবন্ত দিগন্ত, যেখানে মুমিন তার অতীতকে পেছনে ফেলে নতুন এক আলোয় উদিত হয়।

যারা হজ্জ করেন, তারা ফিরে আসেন অন্য রকম হয়ে। চোখে থাকে এক গভীর শান্তি, কণ্ঠে থাকে বিনয়ের ঝরনা, হৃদয়ে থাকে নতুন করে জীবন শুরু করার স্পর্ধা। হজ্জ যেন এক স্বর্গীয় পুনর্জন্ম—যেখানে মানুষ নিজেকে ফিরে পায় আরও পবিত্র, আরও সত্যনিষ্ঠ এক মানুষ হিসেবে।

হজ্জের প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি সূর্যোদয়ে ও প্রতিটি অশ্রুজলে ফুটে ওঠে ইসলামের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য—যেখানে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিই জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য। এমন ইবাদত এই পৃথিবীতে আর নেই, যা এতো সরল, অথচ এতো গভীর; এতো নিরব, অথচ এতো প্রভাবশালী।

এই ইবাদতের মাহাত্ম্য কেবল আখিরাতের প্রাপ্তিতে নয়, বরং দুনিয়ার জীবনেও এটি এক নতুন আবর্তন। হজ্জের পর এক মুসলিম যদি সত্যিকার অর্থে পরিবর্তিত না হন, তবে সেই সফর কেবল ভ্রমণই থেকে যায়। কিন্তু যিনি অন্তর দিয়ে হজ্জ করেন, তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় হয়ে ওঠে যেন এক চলমান তাওয়াফ—আল্লাহর দিকে ফিরে ফিরে আসার অবিরাম সাধনা।

হজ্জ তাই কেবল একটি ইবাদত নয়, এটি এক জীবনদর্শন, একটি নিরব বিপ্লব, যা মানুষের ভেতরের অন্ধকার দূর করে এনে দেয় আলোর নিরবধি ছায়া।

“হজ্জ হলো এক আধ্যাত্মিক উল্লম্ফন—যেখানে মুমিন তার সমস্ত ভার ঝেড়ে ফেলে হালকা হয়ে যায় আল্লাহর রহমতের আকাশে।”

লেখক, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো,মিশর

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top