আসগর সালেহী, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের জন্য গত এক দশক যেন নিরাপদ দুর্গে পরিণত হয়েছিল। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিরোধী মত দমন, মিথ্যা মামলা, প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্যাতন—এমন নানা অভিযোগে মুখর ছিল পুরো উপজেলা। বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন। অনেককে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়, কেউ বছরের পর বছর জেল খেটেছেন।
ভূজপুরে মামলা বাণিজ্যের ভয়াবহতা
উপজেলার ভূজপুর, নারায়ণহাট, দাঁতমারা, হারুয়ালছড়ি, সুয়াবিল, ধুরুং, দৌলতপুর, পাইন্দং, সুন্দর ও নাজিরহাট এলাকায় আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে বিরোধীদের নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা পুলিশের সাথে বসে মামলা বাণিজ্য চালিয়ে গেছেন। হেফাজত, বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের নামে একাধিক ভিত্তিহীন মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। এসব মামলায় অনেকে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন, কেউ দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দি ছিলেন। ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হতো বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
ক্ষমতার পালাবদলেও ফটিকছড়িতে ফ্যাসিস্টদের দাপট
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশে যখন ফ্যাসিস্ট নেতারা আত্মগোপনে চলে গেছে, তখন ফটিকছড়ির চিত্র ভিন্ন। এখানকার জুলাই বিপ্লব মামলার আসামিরা দিব্যি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাজার, চায়ের দোকান, সামাজিক অনুষ্ঠান—সবখানেই দেখা মিলছে তাদের। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে গোপনে সখ্যতা গড়ে গ্রেফতার এড়ানোর চেষ্টা করছে। অপরদিকে দেশে যখন ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলছে, ফটিকছড়িতে তার প্রভাব নেই বললেই চলে। প্রশাসনকে জানালেও তারা নানা অজুহাত দেখিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
আওয়ামী দোসরদের ব্যবসা দেখাশোনা করছে বিরোধীরাই
স্থানীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের ব্রিকফিল্ড, জায়গা-জমি, মাটি ও গাছের ব্যবসা এখন দেখাশোনা করছে বিরোধী দলের একাংশ। সেই সময়ের সুবিধাভোগীরা ক্ষমতার পালাবদলে নিজেদের রং বদলে ফেলছে। এসব সুবিধাবাদীরা আগে আওয়ামী লীগের সাথে মিলে ব্যবসা বাণিজ্য করেছিলো, এখন তারাই উভয় পক্ষের সাথে রফাদফা করে মধু খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তারা আগেও ছিলো সুবিধাভোগী এখন নিচ্ছে।
আওয়ামী দালাল থেকে বিএনপি-জামায়াত নেতায় রূপান্তর
এক সময় যেসব ব্যক্তি আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থেকে বিরোধীদের দমন করেছেন, অনলাইন অনলাইনে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের পক্ষে কাজ করেছিলো তারা এখন বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে ঢুকতে মরিয়া। উপজেলা জামায়াতের দায়িত্বশীলদের একাধিকবার ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা সাড়া দেননি। তবে ভূজপুরের বাসিন্দা, চট্টগ্রাম শহরের চাঁদগাঁও ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি মো. মুনছুরুল হাসান জিয়া বলেন, “যারা একসময় আওয়ামী লীগের দালালি করেছে, তারা এখন বিএনপি-জামায়াতের ছায়ায় ঢুকতে চাইছে। জনগণ তাদের চিনে। তাদের দলে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে দেওয়া হবে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে উর্ধ্বতন নেতাদের জানানো হবে।”
বিএনপির পক্ষ থেকেও অনুরূপ সতর্কবার্তা এসেছে। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জানান, “আগে যারা আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করেছে, তারাই এখন বিএনপির রাজনীতিতে ঢুকতে চাইছে। আমরা সতর্ক আছি। দলের জন্য ত্যাগ করা নেতাকর্মীরাই নেতা হবে। সুবিধাবাদীদের ঠাঁই নেই।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় চরিত্র হননের নতুন কৌশল
এছাড়া ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে বিরোধী নেতাকর্মীদের চরিত্র হননের অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। মিথ্যা পোস্ট, বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ও গুজব ছড়িয়ে ত্যাগী নেতাদের হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের একাংশ এই কাজের পেছনে সক্রিয়।
ত্যাগীদের অবমূল্যায়নের অভিযোগ
রাজপথে যারা কারাবরণ করেছেন, এলাকা ছাড়া হয়েছেন, তাদের অবমূল্যায়নের অভিযোগও উঠেছে। রাজনীতির মাঠে বহু ত্যাগী নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, নতুন সুবিধাবাদীরা দলে প্রবেশ করে নেতৃত্ব দখলের চেষ্টা করছে। এতে সংগঠনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যারা দীর্ঘ সময় দলের জন্য ত্যাগ দিয়েছে, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।
সরেজমিনে দেখা যায়
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, যাঁরা একসময় জয়বাংলা স্লোগানে মুখর ছিলেন, তারাই এখন আওয়ামী লীগ বিরোধী ব্যানারে সক্রিয়। স্থানীয়দের ভাষায়, “এসব সুবিধাবাদী ব্যক্তিরা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতেই অবস্থান বদল করেছে। কিছুদিন আগেও যারা ‘জিতবে এবার নৌকা’ বলে প্রচারণায় ব্যস্ত ছিল, এখন তারাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মিছিলে হাঁটছে।” বড় বড় নেতাদের সাথে সেলফি তুলে ফেসবুকে দিচ্ছে।
দক্ষিণ ফটিকছড়ি, খিরাম, কাঞ্চননগর, হারুয়ালছড়ির হাজারিখিল, ভূজপুরের আছিয়া ও কৈয়া চাগান এবং আদর্শগ্রাম, বেড়াজালি সহ বিভিন্ন এলাকার টিলা-টঙ্গর ও নির্জন স্থানে সারাদিন সময় কাটালেও সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে তারা দল বেঁধে এলাকায় ঘুরাফেরা শুরু করে। স্থানীয়দের অভিযোগ, সম্প্রতি এলাকায় চুরি-ছিনতাই, বাড়িঘরে হামলা এবং বিরোধীদের উপর অতর্কিত আক্রমণের পেছনে এদেরই হাত রয়েছে। এ অবস্থায় এলাকার সাধারণ মানুষ চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
ফটিকছড়ির রাজনীতিতে নতুন মোড়
রাজনৈতিক ভারসাম্যের এই পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে ফটিকছড়িতে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে বলছেন, সামনে আসল পরিবর্তন হবে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।