আসগর সালেহী, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
আজ বিশ্ব চা দিবস। চার কাপের চেয়ে বেশি চায়ের দেশে চায়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ প্রবল হলেও বছরের পর বছর অবহেলিত থেকে যাচ্ছেন এই শিল্পের প্রাণ — চা শ্রমিকেরা। ন্যায্য মজুরি, মৌলিক অধিকার আর মানবিক জীবনের আশ্বাস আজও অধরা। উৎসবের আলোয় মুখর থাকে চা বাগান, অথচ অন্ধকারে হারিয়ে যায় শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাস। তাদের কষ্ট, সংগ্রাম আর বঞ্চনার গল্প যেন বরাবরই আড়ালে।
পাটের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত হলো চা শিল্প। অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার প্রায় ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা। রপ্তানি আয়ও বাড়ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যা দাঁড়িয়েছে ৪৫৮ কোটি টাকায়, আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। অর্থনীতিতে এই শ্রমঘন শিল্পটির অবদান দিন দিন বাড়লেও, এই শিল্পের মূল কারিগর শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি।
চট্টগ্রামের চা শিল্প ও উৎপাদন পরিস্থিতি
চট্টগ্রামের ২২টি চা বাগানের মধ্যে ১৭টি রয়েছে ফটিকছড়ি উপজেলায়। রাঙ্গুনিয়ায় ৩টি এবং কাপ্তাই ও বাঁশখালিতে ১টি করে বাগান। ২০২৪ সালে এসব বাগানে মোট ১ কোটি ৮ লাখ ২০ হাজার ৪৫০ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ কেজি। তবে বছরের প্রথম পাঁচ মাসের উৎপাদন প্রবণতা বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, আগের বছরের মতো এবারও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না।
২০২৩ সালে উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৮৮৩ কেজি এবং ২০২২ সালে ১ কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার ২৯ কেজি। উৎপাদন কিছুটা ওঠানামা করলেও অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা এবং রপ্তানি আয় ২০২৪ সালে ১২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪৫৮ কোটি টাকা।
শ্রমিকদের জীবনমান : চরম অবহেলা
এই শিল্পে বর্তমানে দেড় লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন, যাদের অধিকাংশই নারী। কিন্তু তাদের দৈনিক মজুরি এখনো ১৭৮ টাকা, যা দিয়ে ন্যূনতম জীবনযাপনও সম্ভব নয়। বাজারে চালের দাম ৭০ টাকা কেজি, তাতে পরিবারের ভরণপোষণ প্রায় অসম্ভব।
নারায়ণহাটের নেপচুন চা বাগানের শ্রমিক তাহেরা বেগমের কথায়, ‘একদিন কাজ করলে ১৭৮ টাকা পাই। এই টাকায় সংসার চলে না।’
কৈয়াছড়া চা বাগানের আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘বৃষ্টি হলে এক টুকরো প্লাস্টিক দিয়েই শরীর ঢাকি। রেইনকোট দেয় না। কিছু বললে চাকরি হারানোর ভয়।’
কর্ণফুলী চা বাগানের কৃষ্ণ মনি জানান, ‘৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করি। দুপুরে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ নেই। এই সামান্য মজুরি দিয়েই সংসার চালাতে হয়।’
বঞ্চনা ও শ্রম আইন বাস্তবায়নে গড়িমসি
২০২৫ সালের সংশোধিত ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন’ অনুযায়ী, চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ন্যূনতম ২২০ টাকা নির্ধারণ, স্বাস্থ্যসেবা, ঝুঁকিভাতা, আবাসন সুবিধা এবং ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু চা বাগানগুলোতে এসব বাস্তবায়িত হয়নি।
শ্রম আইন ও বিধিমালা অনুসারে শ্রমিকদের জন্য টয়লেট, নিরাপদ পানি, স্থায়ী আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা থাকার কথা। ২০১৫ সালের বিধিমালায় প্রতিবছর ১০ শতাংশ ঘর পাকা করার নির্দেশনা থাকলেও তা উপেক্ষিত। হাসপাতালগুলোতেও বড় রোগের চিকিৎসা মেলে না।
আন্তর্জাতিক পরিসরে মজুরি বৈষম্য
বাংলাদেশে চা শ্রমিকেরা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম মজুরি পান। ভারতে দৈনিক ২ ডলার (প্রায় ২৪০ টাকা) এবং শ্রীলঙ্কায় ৫ ডলার (প্রায় ৬০০ টাকা) মজুরি দেওয়া হয়, সাথে স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসন সুবিধা। অথচ বাংলাদেশে শ্রমিকেরা পাচ্ছেন ১৭৮ টাকা এবং ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাও নেই।
দারিদ্র্যের করুণ চিত্র
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশের চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর ৭৪ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে। জাতীয় পর্যায়ে এ হার ২৪ শতাংশ। ২০২৫-এর তথ্যে এ অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি, বরং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জীবনযাত্রা আরও কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
শুধু প্রতিশ্রুতি, বাস্তব উদ্যোগের অভাব
প্রতি বছর মে দিবসে উন্নয়নের গল্প শোনা গেলেও শ্রমিকদের জীবনে পরিবর্তন আসে না। চা বোর্ড, শ্রম অধিদপ্তর এবং মালিকপক্ষ কেবল বৈঠক আর ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব সারছে।
সমাধান ও টেকসই উন্নয়নের করণীয়
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের নবম বৃহত্তম চা উৎপাদক। এই সাফল্যের কারিগর শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, মৌলিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা জরুরি। শ্রম আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী সুবিধা নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষায়ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে।
চা শিল্পের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে রাষ্ট্র, মালিকপক্ষ ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।