আরাফাত হোসাইন, বাকৃবি প্রতিনিধি
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে শিক্ষক নিয়োগে চলে আসা বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ অবশেষে মেধার বিজয়ের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি লাভ করল। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন প্রশাসন সম্প্রতি পাঁচজন যোগ্য প্রার্থীকে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দিয়ে একটি সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে এক নীরব বিপ্লব, যেখানে মেধাই একমাত্র মানদণ্ড।
নবনিযুক্ত পাঁচজন শিক্ষক হলেন ইন্টারডিসিপ্লিনারি ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটির সহকারী অধ্যাপক ড. অনিরুদ্ধ সরকার, কৃষিতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মাসুদ রানা, পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. শরিফুল ইসলাম, কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. লামিউর রায়হান, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম সাইফ।
নবনিযুক্ত সহকারী অধ্যাপক ড. অনিরুদ্ধ সরকার বলেন, ‘২০১১ সালে অনার্সে পঞ্চম ও মাস্টার্সে প্রথম হওয়া সত্ত্বেও আমাকে দুইবার শিক্ষক নিয়োগ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, শুধুমাত্র আমি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটিতে ছিলাম বলে। আমার চেয়ে কম মেধাবী প্রার্থীরাও তখন নিয়োগ পেয়েছিল। এমনকি রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে এনএসআই ভেরিফিকেশনেও চারটি সরকারি চাকরি হাতছাড়া হয়।’
নবনিযুক্ত সহকারী অধ্যাপক ড. মাসুদ রানা বলেন, ‘২০১১ সালে কৃষি অনুষদের অনার্সে তৃতীয় স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদক পেয়েছিলাম। কিন্তু জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটিতে থাকার কারণে আমাকে দুইবার শিক্ষক নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। আমার চেয়ে কম যোগ্য প্রার্থীরাও তখন সুযোগ পেয়েছিল।’
নবনিযুক্ত সহকারী অধ্যাপক ড. শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘২০১২ সালে অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন আমি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলাম। এজন্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাকে হল থেকে বের করে দেয়। বাইরে ভাড়া বাসায় থেকে অনার্সে প্রথম হই। পরে ডেনমার্ক থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করি। ২০১৮ সালে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি হলে আবেদন করি, কিন্তু আমার চেয়ে পিছিয়ে থাকা একজনকে বাছাই করা হয়েছিল। বর্তমান প্রশাসনকে ধন্যবাদ, আমাদের দেশের সেবা করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।’
নবনিযুক্ত সহকারী অধ্যাপক ড. লামিউর রায়হান বলেন, ‘২০০৯-১০ সালে অনার্স এবং ২০১৫ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করি ৪.০০ সিজিপিএ পেয়ে। আমি প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেলও পেয়েছি। ২০১১ সালের ৫ জুন ছাত্রলীগের অপকর্মের প্রতিবাদ করায় আমাকে ও আরও ৬৬ জনকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের কর্মীদের হামলায় আমার হাত ও পা ভেঙে যায়। অনেক নির্যাতনের মধ্যে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করি। ২০১৫ সালের শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষার সময়, তৎকালীন উপাচার্যের পাশের কক্ষে থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি বাবুসহ ৮ জন অস্ত্রসহ এসে আমাকে হুমকি দিয়ে চলে যেতে বলে। তারা বলে, না গেলে গুলি করবে। তৎকালীন প্রক্টর ও প্রশাসন কোনো সহায়তা করেনি। পরে পুলিশ এসে আমাকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যায়। অসংখ্য শহীদ ও সাধারণ শিক্ষার্থীর ত্যাগে আজ আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ পেয়েছি।’
জানা যায়, ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯৮তম সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমে কিছু নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, যা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ছিল, মেধাবী প্রার্থীদের উপেক্ষা করে প্রভাবশালী শিক্ষকদের ঘনিষ্ঠজনদের অগ্রাধিকার দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব অনিয়ম বাকৃবির ভাবমূর্তিতে বড় ধাক্কা দিয়েছিল।
বর্তমান প্রশাসন সেই কলঙ্ক মোচনে সাহসী পদক্ষেপ নেয়। এবারের নিয়োগে কেবল মেধাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, কোনো রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই। পাঁচজন নবনিযুক্ত শিক্ষক প্রমাণ করেছেন, সততা ও যোগ্যতা শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়। এই নিয়োগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য যেমন ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনি প্রতিষ্ঠা করেছেন মেধার মর্যাদা।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘এটি শুধু পাঁচজনের নিয়োগ নয়, এটি বাকৃবির জন্য একটি নৈতিক বিজয়। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিজেও অনার্সে প্রথম হয়েছিলাম, তাই মেধার মূল্য কতটা তা জানি। বিগত ১৪ বছর মেধাবী অনেকেই ধর্ম, আদর্শ কিংবা রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে বঞ্চিত হয়েছেন। আমরা চেষ্টা করেছি অন্তত কিছুটা হলেও সেই অবিচার দূর করতে। এই উদ্যোগ যেন দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রেরণাদায়ী হয় কারণ মেধা যেখানে সম্মান পায়, সেখানেই গড়ে ওঠে জাতির ভিত্তি।’