আবু রায়হান, রাজশাহী কলেজ প্রতিনিধি
তালাবদ্ধ এক কক্ষ প্রচণ্ড রোদ্দুরে রাজশাহী কলেজের ছায়াঘেরা এক করিডোর। শিক্ষার্থীরা যে করিডোরে প্রতিদিন হেঁটে যায়, সেখানেই বহু বছর ধরে তালাবদ্ধ পড়ে রয়েছে একটি রহস্যময় কক্ষ। অজানা সেই কক্ষে বন্দি আছে একটি জাদুঘর, রাজশাহী কলেজের শতবর্ষী সংগ্রহশালা। কত গল্প, কত ইতিহাস, সবই যেন বন্দি তালার ওপারে। শেষমেশ দীর্ঘ আবেদন-নিবেদনের পরে গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য এক দুপুরে খোলা হয় সেই কক্ষটি। ধুলোর গন্ধে ভরা ঘরে পা রাখতেই চোখে পড়ে ইতিহাসের নিঃশব্দ কান্না।
রাজশাহী কলেজ ইতিহাসের একটি জীবন্ত দলিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজেই প্রতিভাবান বহু মানুষ গড়ে উঠেছেন। অথচ সেই ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটি বছরের পর বছর পড়ে আছে অযত্নে, অবহেলায়, এমনকি অনেকে এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানেই না।
জাদুঘরের তালা খুলে দেখা গেল, কক্ষটি আগে থেকেই কিছুটা পরিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও লুকানো যায়নি দীর্ঘদিনের অবহেলার ছাপ। ধুলোমাখা প্রতিকৃতি, সালবিহীন ছবির ফ্রেম, ছেঁড়া ফাইল আর অযত্নে পড়ে থাকা বই আর নথিপত্র যেন সময়কে সাক্ষী রেখে প্রশ্ন করে—“আমাদের কী কেউ মনে রাখবে না?”
এই ছোট এককক্ষের জাদুঘরটিতে রয়েছে বহু দুর্লভ নিদর্শন। ব্রিটিশ আমলের ৮টি ঘড়ি,৩টি রেডিও ও আয়না,২টি পুরস্কার মেডেল,৩৪টি কাঠের ওপর ছাপা ঐতিহ্যের ছবি,২টি মাইক্রোস্কোপ ও ৬টি বিজ্ঞান যন্ত্র প্রাচীন বই, প্রিন্টিং অলমেট ও শিক্ষকদের ওনারবোর্ড। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ঐতিহাসিক এসব সম্পদের সংরক্ষণের জন্য নেই কোনো উদ্যোগ। এসবই এক সময় কলেজের গৌরবময় দিনগুলোর সাক্ষ্য ছিল, কিন্তু আজ ধুলো ও মাকড়সার জালে ঢাকা পড়ে অদৃশ্য প্রায়।
এমন একটি মূল্যবান জাদুঘরের অস্তিত্ব পর্যন্ত জানেন না রাজশাহী কলেজের বর্তমান লাইব্রেরিয়ান। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও নেই কোনো জানাশোনা। সামিয়া ফেরদৌস, এক শিক্ষার্থী বিস্ময় নিয়ে বলেন, “রাজশাহী কলেজে জাদুঘর আছে! আমি কখনো শুনিইনি।” আরেক শিক্ষার্থী আব্দুস সামাদ আক্ষেপ করে বলেন, “কলেজের ইতিহাস জানার আগ্রহ থাকলেও জানার সুযোগ পাইনি। হয়তো আমাদের জানতেই দেওয়া হয়নি।”
শিক্ষকরাও বলছেন, শ্রেণিকক্ষে কলেজের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হয় না বললেই চলে। শিক্ষার্থীদের কাছে কলেজ মানেই এখন স্রেফ পাঠ্যবই আর পরীক্ষা।
রাজশাহী কলেজের ইতিহাস বিজরিত জাদুঘর কেন এভাবে অবহেলায়-অযত্নে পড়ে থাকবে আর কেনইবা এই জাদুঘরটি সম্পর্কে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জানার বাইরে রয়েছে। কলেজ প্রশাসনকে এই প্রশ্নগুলো করেন একজন সাংস্কৃতিক কর্মী, অলিউর রহমান বাবু, তিনি বলেন, কলেজের জাদুঘর কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য, জাদুঘর এই কলেজের একটি ঐতিহ্য ও কালের নিদর্শন আর এটিকে অবমূল্যায়ন করে প্রশাসন তাদের চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মু. যহুর আলী বলেন, জাদুঘরের উন্নয়ন সম্পর্কে আমাদের এখন পর্যন্ত কোনো কার্যক্রম করা হয়নি।বর্তমানে জাদুঘরের গুরুত্ব সম্পর্কে যারা অবহিত তাদের ও সরকারের সহায়তা থাকলে জাদুঘরের উন্নয়ন করা সম্ভব।’
শিক্ষার্থী বায়জিদ সরকার বলেন, “জাদুঘরটি সংস্কার করে সকল শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। তা না হলে এসব নিদর্শন হারিয়ে যাবে, আর ইতিহাস হারালে জাতিও দিশাহীন হয়।” শুধু বায়জিদ নয়, বহু শিক্ষার্থীই চান রাজশাহী কলেজের অতীত শুধু বইয়ের পাতায় নয়, দৃশ্যমান হোক জাদুঘরের ভেতরে, মুক্ত হোক সাধারণের জন্য।
এই জাদুঘরটি রাজশাহী কলেজের ইতিহাস, গৌরব আর উত্তরাধিকারের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। বছরের পর বছর সেটিকে তালাবদ্ধ রেখে, অবহেলায় চাপা দিয়ে আমরা কি নিজেদেরই ইতিহাস ভুলে যাচ্ছি?
প্রশ্ন রইল, রাজশাহী কলেজ প্রশাসন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা ইতিহাস-সচেতন সমাজ কি এগিয়ে আসবে না এই জাদুঘর পুনর্জাগরণের উদ্যোগে? একটি জাতির জন্য ইতিহাসের চেয়ে বড় সম্পদ আর কিছু নেই। তাই প্রয়োজন শুধু তালা খোলার নয় মনের জানালাও খোলার।