আম্মার হোসাইন:
কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি ইসলামের নিদর্শন ও তাওহিদের বহিঃপ্রকাশ। কুরবানী—শুধু একটি ধর্মীয় বিধান বা পশু জবাইয়ের নাম নয়; এটি এক গভীর আত্মিক সাধনার প্রতীক, এক অনন্য ত্যাগ ও নিবেদনের ইবাদত। এটি এমন এক প্রার্থনা, যেখানে অস্তিত্বের অন্তরতম প্রিয় বস্তুটিকেও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে হয়। আর এই আত্মোৎসর্গের মাধ্যমেই মুমিন হৃদয় আল্লাহর সান্নিধ্যের সোনালি আলোয় উদ্ভাসিত হয়।
ইসলামে কুরবানির শাব্দিক অর্থই হলো “নিকটবর্তী হওয়া”। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই এর চূড়ান্ত লক্ষ্য। একজন প্রকৃত মুমিন যখন তার কষ্টার্জিত সম্পদ থেকে একটি নির্দিষ্ট পশু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে, তখন সেটি শুধু রক্ত ও গোশতের বিনিময় হয় না—বরং আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায় তার নিয়ত, তাকওয়া ও নিষ্ঠা।
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন: “তুমি তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর।” (সূরা কাওসার: ২)
আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, “এগুলোর (কুরবানির পশুর) গোশত ও রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ: ৩৭)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন: “আর উট ও গরুকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি, এতে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে।” (সূরা হজ্জ: ৩৬)
হাদিসভিত্তিক দলিলসমূহ:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“কিয়ামতের দিন কুরবানির পশু তার শিং, চামড়া ও খুরসহ নিয়ে হাজির হবে। আর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। সুতরাং তা খুশি মনে করো।” (সুনান ইবনু মাজাহ: ৩১২৭, সহীহ)
“কুরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকি লেখা হয়।” (সুনান তিরমিযী: ১৪৯২)
“ঈদুল আযহার দিনে মানুষের যে কাজটি আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়, তা হচ্ছে কুরবানির পশুর রক্ত প্রবাহিত করা।” (সুনান তিরমিযী: ১৪৯৩)
সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এই কুরবানী কী?’ তিনি বললেন, ‘এটি তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আঃ)-এর সুন্নত।’ (সুনান ইবনু মাজাহ: ৩১২৬)
ইতিহাসগত প্রেক্ষাপট:
ইব্রাহিম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ)-এর কুরবানী:
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) যখন স্বপ্নে তার প্রিয় সন্তান ইসমাঈল (আঃ)-কে কুরবানী করার নির্দেশ পান, তখন তিনি তা পালন করতে প্রস্তুত হন। আল্লাহ তাদের এই আত্মত্যাগের মনোভাবের কদর করেন এবং একটি পশু দ্বারা ইসমাঈল (আঃ)-কে মুক্ত করে দেন। ইব্রাহিম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ)-এর কুরবানির ঘটনার শেষে আল্লাহ বলেন:
“আর আমি তাঁর পরিবর্তে একটি মহান কুরবানী দিলাম।” (সূরা সাফফাত)
এই ঘটনাই কুরবানীর প্রকৃত তাৎপর্য: আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা। আল্লাহর পথে কোনো ত্যাগই বড় নয়, বরং ত্যাগের মানসিকতাই একমাত্র পথ যা আমাদের আল্লাহর দরজায় পৌঁছে দেয়। কুরবানির মাধ্যমে মানুষ আত্মতুষ্টি ও পার্থিব মোহকে ছিন্ন করে, লোভ-অহংকার ত্যাগ করে এক পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের দিকে এগিয়ে যায়। এটি কেবল আল্লাহর পথে পশু জবাই নয়; বরং নিজের কামনা, অহংকার ও স্বার্থপরতাকেও জবাই করার অনন্য অনুশীলন।
এই ভাবগম্ভীর ও মহিমান্বিত ইবাদতের মাধ্যমে মুমিন হৃদয়ে জাগে এক গভীর সংযোগ—প্রভুর সঙ্গে আত্মার কথোপকথন। তখন আর কুরবানি কেবল ঈদের দিনের আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং তা হয়ে ওঠে হৃদয়ের গভীর আরাধনা, জীবনের একটি রূপান্তরময় বাঁক।
কুরবানির উপকারিতা:
আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম এটি। কুরবানী মানুষকে শিক্ষা দেয় ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের। এর মাধ্যমে সমাজে গড়ে ওঠে সহমর্মিতা ও দানশীলতার চর্চা। কুরবানীর গোশত ধনী-গরিব সবার মাঝে বন্টন হয়, যা সামাজিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধকে শক্তিশালী করে।
রাসূল (সা.) বলেন: “তোমরা খাও, সংরক্ষণ করো এবং গরিবদের খাওয়াও।” (তিরমিযী)
এটি সুন্দর চরিত্র গঠনে সহায়ক। ত্যাগ, নিয়ত বিশুদ্ধতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কুরবানী ব্যক্তি চরিত্রে নৈতিক দৃঢ়তা আনে। মানুষ লোভ, কার্পণ্য ও অহংকার থেকে মুক্ত হয়।
এছাড়া কুরবানী ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ও শীয়ার। এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও তাওহিদের দৃষ্টান্ত। এটি ইসলামের একটি পরিচয়—যা মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও ইবাদতে দৃঢ় রাখে।
তাই আসুন, আমরা এই কুরবানির মৌসুমে শুধুমাত্র পশু জবাই করে না, বরং আমাদের অন্তরের গ্লানি, অহংকার, হিংসা ও গর্বকেও আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করি—যাতে করে তাঁর রহমত, নৈকট্য ও ভালোবাসা আমাদের জীবনে নেমে আসে অফুরন্ত বরকতের বৃষ্টি হয়ে।
শিক্ষার্থী, ইসলামি আইন বিভাগ, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো, মিশর