২৩শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৯শে সফর, ১৪৪৭ হিজরি

জাবালে তূর, এক পাহাড়ি প্রেমের অভিযান

শরীফ সালাউদ্দিন:

জীবনে অনেক সফর আসে, আবার হারিয়েও যায়। কিছু সফর স্মৃতির পাতায় ঝাপসা হয়ে যায়, আবার কিছু সফর হৃদয়ে এমন দাগ কাটে, যা চাইলেও ভুলে থাকা যায় না। তূর পাহাড়ের সফরটি ছিল তেমনই এক ভিন্নতর অভিজ্ঞতা। এটি কেবল একটি ভ্রমণ ছিল না, বরং ছিল এক আত্মিক অভিযান, ঈমানের জাগরণ, আর ভালোবাসার এক কঠিনতম পরীক্ষা।

মিশরে আসার পর বদলে গেছে আমার দেখার চোখ। দেশে পাহাড়-সমুদ্র ঘুরতে যাওয়ার আগ্রহ ছিল না বললেই চলে, কিন্তু মিশরের হাজার বছরের ইতিহাস, নবী-রাসূলদের স্মৃতিচিহ্ন—এগুলো যেন হৃদয়ে গভীর কোনো আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে।

কক্সবাজারের গল্প যতই শুনি, কখনো মনে হয়নি সেখানে যেতে হবে। অথচ তূর পাহাড়, এটা যেন ভেতর থেকেই ডেকে উঠছিল। এক প্রেমময় ডাক: “এসো, আমায় ছুঁয়ে যাও! এটাই সেই পাহাড়—যেখানে মূসা (আঃ) আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিঃশব্দ রাতে খালি পায়ে উঠতেন, আট হাজার ফিট উচ্চতায় উঠে তাঁর রবের সাথে কথা বলার সৌভাগ্যে ধন্য হতেন। আজও সেই পবিত্র স্মৃতি যেন প্রতিটি পাথরে খোদাই হয়ে আছে।

কায়রো থেকে যাত্রা শুরু হতেই বুঝেছিলাম, এই সফর কেবল শরীর দিয়ে পাহাড় ডিঙানোর নয়, এটা আত্মারও এক অভিযাত্রা। সীনাই অঞ্চলের পথে একের পর এক চেকপোস্ট, কড়া নিরাপত্তা, জিজ্ঞাসাবাদ—সবকিছুই মনে করিয়ে দিচ্ছিল, এ এক আলাদা অঞ্চল, এক ভিন্ন পরিবেশ।

অবশেষে রাত ১টায় আমরা পাহাড়ে ওঠা শুরু করলাম। সাথে ছিলেন স্থানীয় এক গাইড—হাস্সান। তাঁকে ৮৫০ পাউন্ডে ঠিক করা হয়েছিল, কিন্তু তার সাহচর্য ও অনুপ্রেরণা ছিল অমূল্য।
মাত্র আধা ঘণ্টা হাঁটার পরেই শরীর যেন অবশ হয়ে আসছিল। পা ক্লান্ত, বুক ধকধক, মন কাঁদছিল বিশ্রামের জন্য। বারবার মনে হচ্ছিল, “চল একটু বসি।” কিন্তু গাইড বললেন, “আর একটু সামনে গেলেই বিশ্রামের জায়গা।”
এভাবেই প্রতিটি ধাপে পাহাড় যেন আমাদের দেহ নয়, বরং মনোবল, ধৈর্য আর প্রেম, সবকিছুরই পরীক্ষা নিচ্ছিল।

পথে বারবার দেখা মিলছিল উটওয়ালাদের। তারা আমাদের মন দুর্বল করার চেষ্টায় ছিল “উটে ওঠুন, সহজ হবে, আর বেশি হাঁটতে পারবেন না।” কিন্তু আমাদের পণ ছিল, এই পাহাড়ে পায় দলেই ওঠবোস ইনশাআল্লাহ্

পাহাড়ের শেষ চার কিলোমিটার ছিল এতটাই খাড়া যে সেখানে উটও চলতে পারে না। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে পা রাখার সময় মনে হচ্ছিল, একটুও ভুল করলেই হয়তো পিছলে পড়ব। এটাই ছিল সফরের সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশ, কিন্তু একইসাথে সবচেয়ে দারুণ অভিজ্ঞতাও।

পথে ছোট ছোট কিছু ঘর ছিল, যেখানে বিশ্রাম নেওয়া যায়। কিন্তু এক কাপ চা ৫০ পাউন্ড, এক লিটার পানি ১০০ পাউন্ড! নিচে যা ১০ পাউন্ডে পাওয়া যায়, এখানে তার দাম দশগুণ। তবুও এই উচ্চতায় এসবই স্বাভাবিক।

ওঠতে ওঠতে বারবার মনে হচ্ছিল, হযরত মূসা (আঃ) কী অবিশ্বাস্য ত্যাগই না করেছিলেন! কোনো নিরাপত্তা, আলো বা গাইড ছাড়াই তিনি ওঠতেন, আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে। আমরাও যেন তাঁর সেই পথে কিছুটা হলেও হাঁটছি। পা চলছিল না, হাঁটু কাঁপছিল, তবুও মনে হচ্ছিল—এই ক্লান্তিই তো প্রেমের সত্যতা।

সকাল সাড়ে পাঁচটায় পৌঁছাই পাহাড়ের চূড়ায়। ফজরের নামাজ আদায় করে চুপচাপ বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর দেখা মিলল সেই মোহময় দৃশ্যের—সূর্যোদয়। চোখের সামনে রঙ বদলাতে থাকা পাহাড়, রোদ্দুর আর ছায়ার খেলা—একটি দৃশ্য, যা শুধু চোখে নয়, হৃদয়ে গেঁথে যায়।

ক্লান্ত দেহ, কাঁপতে থাকা হাঁটু, শুকনো গলায় চা—সবকিছুর পরেও মনে হচ্ছিল, এই কষ্টই তো সফরের আসল উপহার। এই ত্যাগই তো প্রমাণ—ভালোবাসা কখনো আরামের পথে চলে না।

চূড়ায় দাঁড়িয়ে দেখা গেল, শুধু মুসলিম নয়—ইহুদি, খ্রিস্টান, নানা ধর্মের মানুষ এসেছে। সবার হৃদয়ে মূসা (আঃ)-এর স্মৃতি। এ যেন প্রমাণ করে, তিনি কেবল নবী নন, বরং এক বিশ্বজনীন আদর্শ, বিশ্বমানবতার শিক্ষক।

আজ এই সফর শেষে আমার শরীর চলছে না। হাঁটতে গেলে ব্যথা, সিঁড়িতে উঠা তো দূরের কথা, বিছানা থেকেও উঠে দাঁড়ানো কঠিন। কিন্তু কোথাও কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ এই কষ্টই তো প্রমাণ করে, প্রেম আর ত্যাগ একে অপরের ছায়া। ভালোবাসা মানে শুধু আরাম নয়, ভালোবাসা মানে পাহাড় বেয়ে উঠে হারিয়ে যাওয়া এক আলোর খোঁজে।

পরিশেষে…তূর পাহাড়ের এই সফর আমার জীবনের এক জ্বলন্ত অভিজ্ঞতা। ঈমান, আত্মত্যাগ, ভালোবাসা—সব কিছু একসাথে লাল হয়ে উঠেছিল এই যাত্রায়। এ যেন এক জীবন্ত দুআ, এক স্পর্শযোগ্য দীক্ষা—যা হৃদয়কে বদলে দেয়, চোখে এক নতুন আলো জাগায়।

শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top