মাগরিবের আজানের পর পরই গ্রামের মাঠ ফাঁকা হয়ে যেত। খেলার ছেলেরা ঘরে ফিরত, গৃহস্থরা মাগরিবের নামাজে ব্যস্ত হতেন, আর একটা ঘর থেকে ভেসে আসত এক অপার্থিব ছন্দ“অ-অজগর আসছে তোড়ে, আ-আম খেতে ভালো লাগে…”। সেই ছোট্ট ঘরটি ছিল গ্রামের নিরক্ষরতা দূর করার একটিমাত্র আলোকস্তম্ভ একজন বৃদ্ধ শিক্ষক, একটি হ্যারিকেন বাতি, আর কিছু কৌতুহলী শিশুর কণ্ঠস্বর।
আজ শহরে বসে, প্রযুক্তির যান্ত্রিক শব্দ আর দুঃসংবাদের ভিড়ে মাঝে মাঝে মনে হয় । আবার কি মাগরিবের পর সেই বর্ণমালার সুর ফিরে আসবে? ফিরে আসবে কি সেই অনাড়ম্বর পাঠশালার সন্ধ্যা?
গ্রামের ছোট্ট ঘরগুলো একসময় ছিল বাংলার প্রাণ। সেখানে শিক্ষার আলো ছড়াতো না কোনো ডিজিটাল প্রজেক্টরের মাধ্যমে, বরং ছড়াতো শিক্ষক-শিক্ষিকার মুখে মুখে ছড়া, গল্প আর বাস্তব জীবনের উদাহরণে। খাতা না থাকলেও মুখে মুখে মুখস্থ হতো পুরো বই। ক্লাসরুম না থাকলেও, শেখার আগ্রহে কেউ পেছনে থাকতো না। সন্ধ্যা নামলেই শুরু হতো পড়াশোনা, হ্যারিকেনের আলোয় ছেলেমেয়েরা শিখতো “ক খ গ ঘ…”।
আজ সেই দৃশ্য ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। শহরের ছোঁয়ায় গ্রাম আধুনিক হয়েছে, কিন্তু শিক্ষার সেই আন্তরিকতাটুকু যেন হারিয়ে ফেলেছে। শিক্ষক নেই, ছাত্রও নেই। আছে কেবল ইন্টারনেট আর ইউটিউবের কিছু ভিডিও যেখানে শেখানো হয়, কিন্তু যোগাযোগ হয় না।
তবে কি হারিয়ে গেল সেই বর্ণমালার সুর?
না, তা আমরা হতে দিতে পারি না।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে সেই শিকড়ের কাছে। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে হবে নতুন আলো, নতুন পাঠশালা। নতুন প্রযুক্তি হোক, কিন্তু তার সঙ্গে থাকুক বাংলার নিজস্বতা। হোক না আজকের পাঠশালা স্মার্টফোন বা ট্যাবের মাধ্যমে, তবুও ছড়া হোক সেই পুরনো সুরে“ই-ইঁদুর ছোটে টিকটিকি তাড়া করে…”
শিক্ষা শুধু ডিগ্রির জন্য নয়, ভাষা ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার অন্যতম বাহন। মাগরিবের পর যদি আবার বাচ্চারা পড়তে বসে তাহলেই হয়তো আমরা এক নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে পারব, যারা জানবে তাদের শিকড় কোথায়।
আমরা যারা শহরে বসে আছি, তারা যদি একটু নজর দিই একটি পুরনো ঘরে আবার জ্বলতে পারে হ্যারিকেন, আবার ছন্দে ছন্দে শোনা যেতে পারে বাংলা বর্ণমালা।
সেই আশাতেই—
মাগরিবের পর আবার যেন ভেসে আসে,
“অ-অজগর আসছে তোড়ে…”
প্রফেসর ইঞ্জি. মুহাম্মদ রাশেদ আল মামুন, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়