২১শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৬শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

নিজের পায়ে হেটে চলাচলের স্বপ্ন আনোয়ারের জন্য এখন দু’চোঁখে শুধুই দুঃস্বপ্ন

মোঃ আমিরুল হক, রাজবাড়ী:

নিজের পায়ে হেটে চলাচলের স্বপ্ন নিয়ে সরকারী ভাবে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে দেশে ফিরবেন এ আশায় থাইল্যান্ডের যান আনোয়ার হোসেন। যেখানে আর কিছু দিন চিকিৎসা নিতে পারলে হয়তো তার স্বপ্ন পুরণ হতো। কিন্তু এ্যাম্বাসী থেকে জানিয়ে দিয়েছেন ৩১ জুলাই দেশে ফিরতে হবে। আর হাসপাতাল থেকে বলছে আরও চিকিৎসা প্রয়োজন।

এ টানাটানিতে এখন চিকিৎসা না নিয়েই দেশে ফিরতে হচ্ছে জুলাই যোদ্ধা আনোয়ার হোসেনের। এ কথা শুনেই এখন তার দু’চোখে দুঃস্বপ্নের ছাপ পড়েছে। তার ইচ্ছা নিজের পায়ে হেটে দেশে ফিরতে চান। তার এ ইচ্ছা কি পুরণ হবে। এ আকুতি সরকারের কাছে জানিয়েছেন আনোয়ার হোসাইন।

তিনি রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার কলিমহর ইউনিয়নের কলিমহর গ্রামের মকবুল হোসাইন ও রোকেয়া খাতুনের ছেলে।

শনিবার সকালে থাইল্যান্ডের হাসপাতালে শুয়ে এ ভাবেই আকুতি জানিয়েছেন সৈনিক আমার বাংলাদেশ এর কাছে। আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি তখন আমার বাবা মারা যায়। তারপর থেকে নানা বাড়ি ও এতিমখানায় থেকে বড় হয়েছি। তারপর যখন কাজ করতে শিখলাম, তখন ঢাকায় আসলাম। পরে সবকিছু ভালোই চলছিল। সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটিতে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করছি। শেষ সেমিস্টার চলছে আর জীবন জীবিকার জন্য পাশাপাশি গার্মেন্টস এ চাকরি করতাম।

পরে ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিয়ে করি। স্ত্রী আকলিমা খাতুন মানিকগঞ্জ সরকারি বিএসসি নার্সিং এ পড়াশোনা করে। মা শুধু গ্রামের বাড়ীতে থাকে। এ নিয়েই আমার পরিবার। মায়ের খরচ আমি চালাই। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গিয়ে গুলশান-২ এর শাহজাদপুর এলাকার কনফিডেন্ট টাওয়ারের মাঝামাঝি এলাকায় বুকে গুলিবিদ্ধ হই। ওই সময়ে উপরে হেলিকপ্টার থেকে, সামনে পুলিশ, বিজিবি, ছাত্রলীগ নেতারা গুলি করছিল।

আনোয়ার বলেন, কোন দিক থেকে যে গুলি এসে আমার বুকে লাগে তা আমি বুঝতে পারি নাই। তখন পাশ থেকে কেউ একজন বলে ভাইয়ের গুলি লাগছে, ভাইকে ধর। পরে আমি আমার বুকের দিকে তাকিয়ে দেখি, আমার বুক দিয়ে অঝড়ে রক্ত পড়ছে।

গুলি লাগার সাথে সাথে আমার বুক থেকে পা পর্যন্ত অবশ হয়ে যায়। তখন সবাই মিলে আমাকে ধরে। পরে পাশে এমজেড হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। আমার অবস্থা খারাপ থাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে আমার মামাতো ভাই লিমন এবং সাথে যারা ছিল তারা আমাকে ধানমন্ডি হাসপাতালে, স্কয়ার হাসপাতালসহ আরো কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু কোনো হাসপাতালে ভর্তি নেয় না।

পরে আমার অফিসের (পালমাল গ্রুপ অফ লিঃ) সহায়তায় ঢাকা এভার কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হই। চিকিৎসক বলে আমার স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি হয়েছে। যার ফলে আমার বুক থেকে পা পর্যন্ত অবশ হয়ে যায়। দীর্ঘ ১৮ দিন এভার কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। ১৮ দিনের চিকিৎসার জন্য ৬ লক্ষ ৭৯ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এ সম্পূর্ণ খরচ আমার কোম্পানী আমাকে দেয়। আমার কোম্পানির প্রতি আমি আজীবনের জন্য চির কৃতজ্ঞ।

আনোয়ার আরও বলেন, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট এভার কেয়ার হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়। তারপরে আমি ৭ দিন বাসায় থাকি। চিকিৎসকরা আমাকে ব্যায়াম করার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমার শারীরিক অবস্থা তখন অনেক খারাপ, ব্যায়াম করবো কিভাবে।

পরে ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট সকালে আবার যাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু ওইদিন ও আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি নিবে না। সারা দিন ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সির সামনে স্টেচারে শুয়ে থাকি।

আমার গলায় ছিল স্টুডেন্ট কার্ড, স্টুডেন্ট কার্ড দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেন। সন্ধ্যার পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমাকে ভর্তি করে। তারপর দীর্ঘ ৬ মাস পর ২০২৫ সালের ২২ জানুয়ারী আমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডের ভেজথানি হাসপাতালে পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, আমি যখন গুলিবিদ্ধ হই, তখন আমার স্ত্রী ৩ মাসের অন্তসত্বা। পরে আমার স্ত্রী এবং মা আমার সাথে সবসময় ছিল। অন্তসত্বা অবস্থায় আমার স্ত্রী একটানা ৬ মাস আমার সাথে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকে। আমার স্ত্রী আমার জন্য তার পড়াশোনা ১ বছর করতে পারেনি। পরে আমার স্ত্রীর হাসপাতালেই পুত্র সন্তান জন্ম হয়। আমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যেদিন দেশের বাইরে থাইল্যান্ডে আসি। ওইদিন ১৪ দিনের ছেলে আরাফ হোসাইনকে রেখে চলে আসি থাইল্যান্ডে।

আনোয়ার হোসেন বলেন, এখন আমার অবস্থা আগের থেকে কিছুটা ভালো। কিন্তু এখনো প্রসাব, পায়খানা বুঝি না, নিজের পা এখনো নিজে নড়াতে পারি না, নিজে নিজে বিছানায় এপাশ-ওপাশ হতে পারি না, নিজে নিজে পিছনের সাপোর্ট ছাড়া বসে থাকতে পারি না। এমন অবস্থায় আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

চিকিৎসকের কাছে রিলিজের কথা জানতে চাইলে বলেন, আপনাদের এ্যাম্বাসী জানে, আর এ্যাম্বাসীর কাছে রিলিজের কথা জানতে চাইলে বলে চিকিৎসক জানে। এ অবস্থায় যদি দেশে পাঠিয়ে দেয়, আমি কি করবো। আমার এখনো বুক থেকে পা পর্যন্ত অবশ। আমাকে জানানো হয়েছে ৩১ জুলাই দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আনোয়ার হোসেন অন্তবর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, আমার একটাই চাওয়া, আমি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরতে চাই। আমি নিজে যেন একটু দাঁড়াতে পারি, শুধু এতটুকুই চাই। প্রসাব-পায়খানার অনুভূতি বুঝতে চাই। এ বিষয়ে অবশ্যই সরকার উদ্যোগ নিবেন বলে দাবী জানান তিনি।

আনোয়ার হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, আমরা দেশের জন্য, নতুন বাংলাদেশের জন্য, চাকুরীর নিশ্চয়তা, খাবারের নিশ্চয়তা, চিকিৎসার নিশ্চয়তার জন্য আন্দোলন করেছি। আর এখন সবাই ব্যস্ত যার যার রাজনীতি নিয়ে। আমাদের চিকিৎসার খবর কেউ রাখে না। এ কারণেই কি আমরা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছি। আর এখন সু-চিকিৎসা নিশ্চিত হওয়া নিয়ে দু’চোঁখে অন্ধকার দেখছি। আমার এ আকুতি কি শুনতে পাবেন, জানি না। আমি শুধু আমার চিকিৎসা নিশ্চিতের দাবী জানাই।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top