জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান:
ভালোবাসা শব্দটি যেন হৃদয়ের সবচেয়ে নরম সুতোয় বোনা এক অনুভব—যা চোখে ধরা যায় না, অথচ হৃদয় স্পর্শ করে অতল থেকে অতলে। কিছু ভালোবাসা থাকে—অলিখিত, অবর্ণিত, অথচ অগাধ; তারা বেজে ওঠে নিঃশব্দে, হৃদয়ের অন্তঃস্থ রন্ধ্রে। ঠিক যেমন আল্লাহর ভালোবাসা—যা কোনো প্রকাশ্য ঘোষণায় নয়, জ্বলে ওঠে আত্মার গহীনে, এক নিভৃত প্রদীপের মতো।
এই প্রেমের পরিমাপ হয় না যুক্তিতে, হয় না চাওয়া-পাওয়ার হিসেব-নিকেশে। এটি এক অবিনশ্বর টান—যেখানে চাওয়া শুধুই কাছে আসা, আর পাওয়া শুধুই অন্তরের প্রশান্তি। যে ভালোবাসায় ক্লান্তি নেই, নেই ফেরতের শর্ত; যা অপেক্ষায় থাকে, যেমন কোনো মা প্রতিদিন চেয়ে থাকে তার সন্তান ফিরে আসবে বলে।
সেই চিরন্তন স্নেহের ঘোষণা—
“তুমি যদি আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসো, আমি এক হাত এগিয়ে আসি; তুমি যদি হেঁটে আসো, আমি তোমার দিকে দৌড়ে আসি।”
(সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
এই হাদীস শুধু শব্দ নয়—এ এক নিঃশব্দ আহ্বান, হৃদয় ভেদ করা ডাক, যা বান্দার আত্মাকে কাঁপিয়ে দেয়। আল্লাহর ভালোবাসা এমনই—শুধু তুমি ফিরো, বাকিটুকু আমার।
জীবনের প্রতিটি সম্পর্ক এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে—প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার ভারে, অমিলের বেদনায়। কিন্তু আল্লাহর ভালোবাসা কখনো ভাঙে না। তুমি ফিরে এলে, সে ভালোবাসা বলে না, “তুমি কেন গিয়েছিলে?”—বরং বলে, “চলো, শুরু করি আবার।”
এই প্রেমের স্পর্শে যে হৃদয় জেগে ওঠে, তার কাছে সালাত আর কর্তব্য থাকে না—তা হয়ে ওঠে প্রেমিকের দরজায় মাথা রাখার মুহূর্ত। সেজদা তখন হয়ে যায় আত্মার আরামের আশ্রয়, কান্না হয়ে যায় আনন্দের অনুবাদ। কুরআনের আয়াতগুলো হয় প্রিয়তমের চিঠি—যেখানে মমতা, ক্ষমা, ও চিরন্তন সান্নিধ্যের প্রতিশ্রুতি লেখা থাকে শব্দের ভাঁজে ভাঁজে।
যারা ভীষণ একা, যাদের হাসির আড়ালে কান্না জমে থাকে, যাদের জীবনে কোনো কাঙ্ক্ষিত আশ্রয় নেই—তাদের জন্য আল্লাহর এই ভালোবাসা এক অনুপম আশ্রয়। এই ভালোবাসা হৃদয়কে শান্ত করে, চেতনাকে পরিশুদ্ধ করে, আত্মাকে তুলে আনে আত্মমর্যাদার শিখরে।
এ ভালোবাসা আধ্যাত্মিক উন্নতির চাবিকাঠি, আবার নৈতিক উৎকর্ষেরও প্রেরণা। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালোবাসে, সে প্রতারণা করতে পারে না, সে কারও ক্ষতি করতে পারে না। তার হৃদয় কোমল হয়, চোখ হয় রহমতের ঝর্ণাধারা। সে মিথ্যা ত্যাগ করে, হিংসা ভুলে যায়, ঈর্ষা হার মানে তার মহত্বের কাছে।
আল্লাহর ভালোবাসা শুধু মসজিদের ভিতরে সীমাবদ্ধ থাকে না—তা ছড়িয়ে পড়ে জীবনের প্রতিটি অনুষঙ্গে। মানুষকে ভালোবাসা, দায়িত্ববোধে জাগ্রত হওয়া, দুনিয়ার প্রতি সংবেদনশীল থাকা, ও পরকালের প্রতি সচেতন থাকা—সবই হয় এই ভালোবাসার স্বভাবিক প্রকাশ।
সত্যিকারের আল্লাহপ্রেমিক ব্যক্তি হয়ে ওঠে আলোর মিনার—সে নিজে জ্বলে, অন্যদের পথ দেখায়। তার জীবনে থাকে অনাবিল শান্তি, কারণ সে জানে—তার সকল ক্লান্তির ঠিকানা আল্লাহর কুদরতপূর্ণ হাত।
আজকের অস্থির, ক্ষতবিক্ষত, অনিশ্চিত পৃথিবীতে এই ভালোবাসাই একমাত্র অবিচল আশ্রয়। যেখানে নেই লোক দেখানো চমক, নেই ফাঁপা প্রতিশ্রুতি—আছে শুধু এক পরম নির্ভরতাবোধ, যাকে বলে—ইয়াকীন।
আসুন, আমরা প্রত্যেকে সেই প্রেমের সন্ধানে নিঃশব্দে যাত্রা করি—যেখানে চাওয়া একটাই—রবের কুঞ্জে আশ্রয়। সেই ভালোবাসার ছায়াতলে যে হৃদয় আশ্রয় নেয়, তার জন্য জগতের আর কিছুই প্রলুব্ধ করে না। কারণ, সে হৃদয় তখন আসমান ছুঁয়ে থাকে।
লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর