২৭শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২রা সফর, ১৪৪৭ হিজরি

লোহার খাঁচায় মিশর, শ্বাসরুদ্ধ গাজা ও আমেরিকার অদৃশ্য শিকল

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান:

মিশরের আকাশে স্বাধীনতার ডাক এখনো ভেসে ওঠে, কিন্তু সেই সুরের উপর সিসির লোহার হাতের ঠান্ডা শব্দ ঝরে পড়ে প্রতিদিন। আল-সিসি যেন এক অদৃশ্য কারাগারের স্থপতি—যিনি রাষ্ট্রকে শাসন করেন না, শ্বাসরোধ করে ধরে রাখেন। কায়রোর রাস্তাঘাটে যে নীরবতা ছড়িয়ে আছে, তা কোনো শান্তির প্রতীক নয়; বরং আতঙ্কের প্রতিধ্বনি। আইন ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে মানুষের কণ্ঠগুলোকে একে একে গলাটিপে ধরা হয়েছে। গণতন্ত্রের নামটি এখন কেবল এক পোড়া মুদ্রা—রঙ আছে, মূল্য নেই।

এই লোহার ছায়া গড়িয়ে পড়েছে গাজার দিকে। রাফা সীমান্তের নীরব কাঁটাতার শুধু ভৌগোলিক রেখা নয়; বরং হাজার হাজার ক্ষুধার্ত, আহত ও আতঙ্কিত মুখের সামনে দাঁড় করানো সিসির অদৃশ্য প্রাচীর। গাজার শিশুদের চোখে যখন পৃথিবী ভেঙে পড়ে, তখন কায়রোর নীরবতা সেই অমানবিকতার সহচর হয়। মানবতার নামে যে দরজা খুলে দেওয়ার কথা, সেটি সিলমোহর মারা হয়েছে নিরাপত্তার মিথ্যে যুক্তিতে। মিশর আজ কেবল একটি রাষ্ট্র নয়; এটি পরিণত হয়েছে এক প্রহরীতে, যে শাসক নিজের সিংহাসন বাঁচাতে মানবতাকেই উৎসর্গ করেছে।

এই ট্র্যাজেডির আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে এক পরাশক্তির ছায়া—আমেরিকা। প্রতিবছর ঝরে পড়া বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা সিসির খাঁচাকে চকচকে করে রাখার পালিশ। ওয়াশিংটনের নৈতিকতা এখন দ্বিমুখো আয়না; এক পাশে মানবাধিকার নিয়ে বক্তৃতা, অন্য পাশে সেই অধিকার গলাটিপে হত্যার সহযোগিতা। ট্রাম্পের সেই নগ্ন উক্তি—“আমার প্রিয়তম স্বৈরশাসক”—শুধু ব্যক্তিগত রসিকতা নয়, বরং মার্কিন নীতির নগ্ন স্বীকারোক্তি। মানবাধিকার আজ সেখানে এক কূটনৈতিক শব্দমাত্র; যার অর্থ তখনই আছে, যখন তা স্বার্থের সঙ্গে মিলে যায়।

মিশরের সাধারণ মানুষের জীবন এখন এক অনন্ত শ্বাসরুদ্ধতা। মূল্যস্ফীতি অগ্নিদগ্ধ, দারিদ্র্য হাহাকার করছে, হাজারো মানুষ অদৃশ্য কারাগারে দিন কাটাচ্ছে। রুটি আর স্বাধীনতা দুই-ই বিলাসে পরিণত হয়েছে। যে আল-আজহার যুগে যুগে মিশরের আত্মা হয়ে থেকেছে, সেখানকার শাইখ যখন গাজার জন্য একটি মানবিক আহ্বান জানানোর চেষ্টা করলেন, সেটিও রাষ্ট্রের ভারী হাতের নিচে চাপা পড়ল। একটি ধর্মীয় বিবেককেও যখন শাসন দমিয়ে রাখে, তখন বোঝা যায়—একটি জাতির আত্মা কতটা বন্দি।

আজ মিশর এক অদৃশ্য কারাগার। গাজা এক শ্বাসরুদ্ধ মরুভূমি। আর আমেরিকা সেই কারাগারের তালাচাবি হাতে নিয়ে দাঁড়ানো এক নীরব কারিগর। মানুষের কান্না হারিয়ে গেছে রাষ্ট্রের কোলাহলে; সিসির প্রতিটি আদেশে যে শ্বাসরোধ হয়, গাজার প্রতিটি মৃতদেহে যে নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে, আর আমেরিকার প্রতিটি স্বাক্ষরে যে আনুগত্যের কালি লেগে থাকে—তার হিসাব ইতিহাস একদিন চাইবেই।

কিন্তু সেই দিন আসা পর্যন্ত মিশরের জনগণ, গাজার শিশু আর ন্যায়বিচারের কণ্ঠগুলো কেবল আকাশে প্রতিধ্বনির মতো ভেসে থাকবে। সিসি হয়তো সেই প্রতিধ্বনিকে দমন করবে, আমেরিকা হয়তো সেটি শুনেও শুনবে না। কিন্তু ইতিহাস জানে—লোহার খাঁচা কখনো চিরকাল থাকে না; একদিন মরচে ধরে ভেঙে পড়ে, আর মানুষের কণ্ঠ তখন আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হয়।

লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো, মিশর

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top