৬ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২২শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১২ই সফর, ১৪৪৭ হিজরি

৫ আগস্ট: অন্তর্বর্তী স্বপ্নের অন্ত্যন্ত কষ্টকর এক বছর

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

বছর ঘুরে আবার এলো ৫ আগস্ট। ইতিহাসের এক অগ্নিঝরা ক্ষণ—যেদিন পতন হয়েছিল এক দুঃশাসনের, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল এক নব্য স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা। জনতার বুক চিড়ে এক ঝলক আলো এসেছিলো যেন, বাতাসে ভেসেছিল মুক্তির গান।

কিন্তু সেই আলো খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কারণ যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিলো, তা পূরণে এসেছিলো আরেকটি মুখোশধারী ব্যবস্থা—অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নামে পরিচিত, কিন্তু চরিত্রে ছিলো অচেনা, অনির্ধারিত এবং অস্পষ্ট।

এই সরকার কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে আসেনি, জনগণের ভোটে নির্বাচিতও নয়। এটিকে বলা হয়েছিলো “স্থায়ী সমাধানের পূর্বপ্রস্তুতি”। কিন্তু সময় পেরিয়েছে বারোটি মাস, আর জনগণের ভাগ্যে যুক্ত হয়েছে আরও বারোটি হতাশা।

কোনো স্থায়িত্ব নেই, নেই কোনো নীতিগত স্বচ্ছতা। রাষ্ট্রের চাকা ঘোরে, কিন্তু কেবল ক্ষমতার মোড় ঘুরে; মানুষের জীবনে কোনো গতি আসে না। যারা এসেছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেই, তারা যেন স্থায়ী মনোবৃত্তি নিয়ে জমে বসেছেন রাষ্ট্রক্ষমতার অলিন্দে।

স্বৈরাচার পতনের পর মানুষ চেয়েছিল হালকা আলো, অন্তত নিঃশ্বাস। কিন্তু বরং সেই শ্বাস এখন আরও ভারী।

চোরাগলিতে ফিরে এসেছে পুরনো সব ভয়—সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিলে জবাবদিহি, সাংবাদিকদের জন্য নিশ্বাসও বিপজ্জনক, নীতিনির্ধারণের নামে চলছে চুপচাপ পুনঃস্থাপন—পুরনো আমলের লোকদেরই ফিরিয়ে আনা হয়েছে নতুন মোড়কে।

এই এক বছরে বদল হয়েছে কিছু মুখ, কিছু ব্যানার, কিছু শ্লোগান। বদলায়নি শাসনের ধরণ, শোষণের কৌশল। বরং যেন আরও চাতুর্যপূর্ণ, আরও মসৃণভাবে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে একটি ‘নিয়ন্ত্রিত বাস্তবতা’—যেখানে আপনি স্বাধীন, কিন্তু শর্তসাপেক্ষে।

রাষ্ট্রের মুখে ‘সংক্রমণকালীন’ শুদ্ধি অভিযান, অথচ ভিতরে চলছে একই পুরনো নোংরামি। প্রতিষ্ঠানগুলো আজো দলীয় আনুগত্যে চালিত, আইনের শাসন আজও আত্মগোপনে।

একটি সরকার, যার কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নেই, যাদের হাতে জনগণের ব্যালট নেই, তার পক্ষে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় ছিলো—সুশাসনের প্রমাণ।
কিন্তু তা কোথায়?

দুর্নীতিবাজেরা ফের দখল নিয়েছে প্রভাবশালী পদে। প্রশাসন চলছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইশারায়। বিচারব্যবস্থা এক প্রহসন, সাংবাদিকতা চলছে ভয় আর স্বার্থের রশিতে বাধা পড়ে।

৫ আগস্ট তাই এখন আর বিজয়ের দিন নয়, এক বছরের ব্যর্থতার দলিল। যে আশা ছিল অন্তর্বর্তী এই সময়টুকু হবে এক নির্মাণের অধ্যায়—তা ভেঙে পড়েছে নখ-দন্তহীন এক প্রহসনে।

রাষ্ট্র আজ এমন এক নৌকায় দাঁড়িয়ে, যার নাবিক আছে কিন্তু গন্তব্য নেই, কণ্ঠ আছে কিন্তু সাহস নেই, সময় আছে কিন্তু দিশা নেই।

এমন অন্তর্বর্তীকাল এক দীর্ঘ শীতকাল—যেখানে বসন্ত আসার অপেক্ষায় আমরা কেবলই জমে যাচ্ছি।

তাই প্রশ্ন করতে হয়—এই বছরব্যাপী ‘অন্তরভর্তী’ সময়ের ফলাফল কী? একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী প্রক্রিয়া? গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনঃপ্রতিষ্ঠা? নাকি আরও এক প্রলম্বিত ক্ষমতাকেন্দ্রিক অন্তর্জ্বালা?

পতনের বছর পূর্ণ হলো, কিন্তু পুনর্গঠনের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না।

রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে আজ তাই বলতে হয়—ক্ষমতা যদি অন্তর্বর্তী হয়, তবে চাওয়া-পাওয়ার হিসাবও হতে হবে অস্থায়ী নয়, চূড়ান্ত।

লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী,
আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top