১২ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৮ই সফর, ১৪৪৭ হিজরি

সচিবালয়ে হাসিনার অনুগত আমলা বিদ্রোহের আশঙ্কা

নিজস্ব প্রতিনিধি:

সরকারের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কেন্দ্র সচিবালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এখনো সক্রিয় রয়েছেন পতিত শেখ হাসিনা সরকারের অনুগত আমলারা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর শীর্ষ পদগুলোতে সামান্য পরিবর্তন হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পূর্ববর্তী সরকারের মনোনীত কর্মকর্তারা তাদের পদে বহাল রয়েছেন। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে হাসিনা সরকারের নিয়োগকৃত প্রায় ৪৬ জন সচিব ও অতিরিক্ত সচিব এখনো দায়িত্বে রয়েছেন, যারা নিয়মিত গোপন বৈঠক করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে ‘জনতার মঞ্চ’ নামে আমলা বিদ্রোহের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করছেন অনেক বিশ্লেষক। বর্তমানে সচিবালয়ে এমন ১১ জন সচিব রয়েছেন যাদের ওএসডি করা হয়েছে, কিন্তু তারা চাকরিতে বহাল আছেন। এদের মধ্যে অনেকেই ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং হাসিনা সরকারের সময়ে ব্যাপক সুবিধা ভোগ করেছেন।

প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে কাজ করা বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর পদোন্নতি পাওয়া পেশাদার আমলাদের বদলে হাসিনা সরকারের সময়ে পদোন্নতিপ্রাপ্ত আমলাদেরই সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে বঞ্চিত পেশাদার আমলাদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না, যা প্রশাসনে অসন্তোষ তৈরি করছে।

অবসরপ্রাপ্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার সম্প্রতি একটি সেমিনারে বলেন, “বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিব বিগত আমলের অপকর্মের হোতা আমলাদের অপসারণে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।” তিনি আরও অভিযোগ করেন যে অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টার দুর্নীতির প্রমাণ তার কাছে রয়েছে।

সাবেক সচিব এএফএম সোলাইমান চৌধুরী সতর্ক করে বলেন, “আওয়ামী ফ্যাসিস্ট অনুসারী আমলারা খুবই ভয়ংকর। এরা এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন এবং সুযোগ পেলে যে কোনো সময় অপ্রত্যাশিত কিছু করতে পারে।”

২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রশাসনে এমন এক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল যেখানে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দলবেঁধে টুঙ্গিপাড়া ও ৩২ নম্বরে গিয়ে শেখ মুজিবের সমাধিতে ফুল দিতেন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তা প্রচার করতেন। এই সময়ে অনেক পেশাদার আমলা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা, কারাবরণ, নিবর্তনমূলক বদলি এবং নানা ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন।

বর্তমানে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান, অর্থ সচিব ড. খায়রুজ্জামান মজুমদারসহ অনেকেই হাসিনা সরকারের সময়ে নিয়োগ পাওয়া আমলা হিসেবে তাদের পদে বহাল রয়েছেন। এদের অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।

দেশের প্রশাসনকে চরমভাবে যারা বিতর্কিত করেছে এবং সচিবালয়কে আওয়ামী লীগের অফিসের কাতারে নিয়েছে এমন ২৬ জন সচিব এখন পলাতক কিংবা কারাগারে। এদের সহযোগিতায় শেখ হাসিনা আওয়ামী ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে। এরা হলেন-

(১) আবুল কালাম আজাদ, মুখ্যসচিব, (এমপি), (বর্তমানে কারাগারে)। (২) নজিবুর রহমান, মুখ্যসচিব, (বর্তমানে কারাগারে)। (৩) কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, মুখ্যসচিব, (বর্তমানে কারাগারে)। (৪) কায়কাউস রানা, মুখ্যসচিব, (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে)। (৫) তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, মুখ্যসচিব, (বর্তমানে পলাতক)। (৬) সাজ্জাদুল হাসান, সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের ভাই), (বর্তমানে পলাতক)। (৭) মো. সোহরাব হোসাইন, সচিব, পিএসসি চেয়ারম্যান, (বর্তমানে পলাতক)। (৮) হেলাল উদ্দিন আহমেদ, সচিব, (বর্তমানে কারাগারে)। (৯) খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, (বর্তমানে পলাতক)। (১০) ইকবাল মাহমুদ, সচিব/দুদক চেয়ারম্যান, (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া পলাতক)।

(১১) কাজী আমিনুর রহমান, সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া পলাতক)। (১২) কবির বিন আনোয়ার অপু, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, (বর্তমানে পলাতক)। (১৩) জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাচন কমিশনার সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, (বর্তমানে পলাতক)। (১৪) জাহাঙ্গীর আলম, স্বাস্থ্যসেবা সচিব, (বর্তমানে কারাগারে)। (১৫) মেজবাহউদ্দিন, সচিব, সেক্রেটারি অফিসার্স ক্লাব, (বর্তমানে কারাগারে)। (১৬) মোহাম্মদ সাদিক এমপি/সচিব/পিএসসি চেয়ারম্যান, (বর্তমানে পলাতক)। (১৭) সালাহউদ্দিন, সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, চাকরিচ্যুত, (বর্তমানে পলাতক)। (১৮) খাইরুল ইসলাম মান্না, সচিব/সদস্য (চুক্তি) বিআইডিএ, (বর্তমানে পলাতক)। (১৯) জুয়েনা আজিজ, সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, (বর্তমানে পলাতক)। (২০) এমএএন সিদ্দিক, সচিব ও পিডি মেট্রোরেল, (২১) খলিলুর রহমান, সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, সদস্য পিএসসি, (২২) খন্দকার শওকত হোসেন, সচিব, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, (শেখ কবির হোসেনের বেয়াই), (২৩) মোস্তফা কামাল, সচিব, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় (বর্তমানে পলাতক), ওএসডি ও সভাপতি বিএএসএ, (২৪) এম আলম, অতিরিক্ত সচিব, শিল্প মন্ত্রণালয় ও মহাসচিব বিএএসএ, (বর্তমানে পলাতক)। (২৫) হারুন অর রশিদ বিশ্বাস, অতিরিক্ত সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, (বর্তমানে পলাতক), দুদক মামলা করেছে। (২৬) আবু হেনা মোরশেদ জামান (৫৬৩৯), সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগ, (বাধ্যতামূলক অবসরে)।

অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের (১৫-১৮ ব্যাচ) পেশাদার এমন স্মার্ট কিছু কর্মকর্তা আছেন, যারা সচিব হবার যোগ্য। তাদের দ্রুত পদোন্নতি দিয়ে সচিব করা হলে অথবা গ্রেড-১ পদে পদায়ন করা হলে প্রশাসনে কিছুটা হলেও ভারসাম্য সৃষ্টি হতে পারে বলে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের অভিমত। বর্তমানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সমর্থক সচিব ও অতিরিক্ত সচিবরা দায়িত্বে থাকলে নির্বাচনের সময় তাদের আসল চেহারা প্রকাশ করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

প্রশাসনিক সংস্কারকামীরা দাবি করছেন, অবিলম্বে এই সকল আমলাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো উচিত। না হলে তারা ২০২৬ সালের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হলে এই সকল আমলাদের দ্রুত প্রতিস্থাপন করা জরুরি।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top