১২ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৮ই সফর, ১৪৪৭ হিজরি

বিএনপি ও যুবদল নেতাদের নেতৃত্বে সিলেটের সাদা পাথরে অবাধ লুটপাট: পরিবেশ ও রাজস্বের মারাত্মক ঝুঁকি

নিজস্ব প্রতিনিধি:

গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র সাদা পাথরে পাথর লুটপাট শুরু হয়। তবে গত দুই সপ্তাহে এ লুটপাটের তাণ্ডবে এলাকাটি লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বিএনপি ও যুবদল নেতাদের নেতৃত্বে এ লুটপাট চলছে। অন্যান্য দলের নেতাকর্মীদেরও এতে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। এতে এলাকার পরিবেশ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

পরিবেশবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, এভাবে লুটপাট চলতে থাকলে দেশের পরিচিত এই পর্যটন স্পটটি বিলীন হয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি সরকার বড় অংকের রাজস্ব হারাতে পারে। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে সাদা পাথরে দিনদুপুরে প্রকাশ্যে লুটপাট চলছে। পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে ভেসে আসা পাথর লুটের মচ্ছব চলছে। ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে বাঙ্কার এলাকাও এ থেকে বাদ যাচ্ছে না। লুটপাটে সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে পড়েছে। চাঁদাবাজির ধরনও পাল্টে গেছে। স্থানীয়রা জানান, গত দুই-তিন মাসে দিনরাতে হাজারের বেশি বারকি নৌকা ব্যবহার করে পাথর লুট হয়েছে। এ তাণ্ডব ঠেকাতে পুলিশ প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লুটপাটের অসংখ্য ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এসব ভিডিওতে দেখা গেছে, সাদা পাথর জিরো পয়েন্টে খোঁড়াখুঁড়ি করে পাথর তোলা হচ্ছে। লুটের ভাগ নিয়ে মারামারিও হচ্ছে।

২০১৭ সালে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায় সাদা পাথর। ওই বছর পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ধলাই নদের উৎসমুখে প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে পাথরের বিশাল স্তূপ জমা হয়, যা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে সংরক্ষিত হয়। পরবর্তীতে আরও কয়েক দফায় পাহাড়ি ঢল নেমে এখানে পাথরের আস্তরণ পড়ে। সেই পাথরের বিছানার ওপর দিয়ে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ পর্যটকদের মুগ্ধ করে। তখনকার জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার ও ইউএনও আবুল লাইছ এলাকাটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে উপজেলা প্রশাসন সংরক্ষণের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। সাবেক ইউএনও সুমন আচার্য সাদা পাথর নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় এলাকাটি ঝুঁকির মুখে পড়ে।

চাঁদাবাজির কৌশলেও পরিবর্তন এসেছে। আগে নৌকাপ্রতি ১৫০০-২০০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হতো। পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করতে আরও ৫০০-১০০০ টাকা লাগত। পাথর উত্তোলনকারীরা প্রতি নৌকা পাথর ৫-৬ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন চাঁদাবাজির নিয়ম বদলেছে। এখন যে কেউ পাথর তুলতে পারবেন, তবে তা নির্ধারিত সিন্ডিকেটের সদস্যদের কাছেই বিক্রি করতে হবে। প্রতি নৌকা পাথর সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকায় বিক্রি করা যাবে। স্থানীয় সূত্রমতে, এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন বিএনপি ও যুবদল নেতারা। গত বছরের ৫ আগস্টের পর পুরো এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।

দিনরাত হাজার হাজার শ্রমিক কোদাল, বেলচা, শাবল নিয়ে মাটি খুঁড়ে পাথর তোলেন। বারকি নৌকায় পাথর বহন করে মিলমালিকদের কাছে বিক্রি করা হয়। পরে মেশিনে ভেঙে ছোট করে ব্যবসায়ীদের কাছে পাঠানো হয়। ট্রাক ও পিকআপে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাথর পাঠানো হয়। গত এক বছরে কত পাথর লুট হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান প্রশাসনের কাছে নেই। স্থানীয়দের ধারণা, সিলেটের পাথর কোয়ারি ও অন্যান্য এলাকা থেকে দুই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সিলেট পাথরশূন্য হয়ে পড়বে।

সিলেট জেলা যুবদলের সহসাধারণ সম্পাদক বাহার আহমদ রুহেল বলেন, ‘পাথর লুটপাটকারীদের বেশিরভাগই সিলেটের বাইরের লোক। তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, ‘গত এক বছরে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পাথর লুট হয়েছে। প্রশাসনের ব্যর্থতাই এ জন্য দায়ী।’ কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের মাহমুদ আদনান বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়, কিন্তু একা পুলিশের পক্ষে এটি ঠেকানো সম্ভব নয়।’ সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘নিয়মিত অভিযান চলছে, তবে জনবল কম থাকায় পুরোপুরি ঠেকানো যাচ্ছে না।’

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top