জাকির হোসেন হাওলাদার, দুমকী ও পবিপ্রবি( পটুয়াখালী) প্রতিনিধি :
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পবিপ্রবি) সহকারী রেজিস্ট্রার (খণ্ডকালীন) মাহমুদ আল জামান কর্তৃক রেজিস্ট্রার শাখার সেকশন অফিসার সাকিন রহমানকে প্রকাশ্যে চরথাপ্পড় মারার অভিযোগ উঠেছে। ১৩ আগস্ট সকাল সাড়ে ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে এ সাকিন রহমান এর অফিস কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। এতে ক্যাম্পাসে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ শিক্ষার্থীরা অভিযুক্তের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
ঘটনার তৎপরবর্তীতে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মোঃ ইকতিয়ার উদ্দিন স্বাক্ষরিত অফিস আদেশ অনুযায়ী, কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন কৃষি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. দেলোয়ার হোসেন। সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন প্রক্টর অধ্যাপক আবুল বাশার খান।
এছাড়া কমিটির অন্যান্য সদস্য হিসেবে রয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোঃ মুহসিন হোসেন খান, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোঃ কবিরুল ইসলাম মজুমদার এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার ড. আমিনুল ইসলাম। কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য, যাতে ঘটনার প্রকৃত সত্য উদঘাটন এবং প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়।
ঘটনার শিকার সেকশন অফিসার সাকিন রহমান বলেন,“কোনো প্রকার উসকানি ছাড়াই মাহমুদ আল জামান এসে আমাকে চরথাপ্পড় মারে। এ ধরনের আচরণ একজন বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তার জন্য চরম নিন্দনীয়। আমি চাই, এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, যাতে আর কেউ কর্মস্থলে এমন অসৌজন্যমূলক আচরণ করার সাহস না পায়।”
পটুয়াখালী জেলার দুমকি উপজেলার রাজাখালী গ্রামের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. জালাল খানের বড় ছেলে মাহমুদ আল জামান অতীতেও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এক ছাত্রীর সাথে একতরফা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। পরে ওই ছাত্রী প্রকাশ্যে তাকে লাঞ্ছিত করলে তিনি মানসিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে পড়েন। এরপর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং শারীরিকভাবে আক্রমণের অভিযোগে তিনি বিচার মুখোমুখি হন।
পরবর্তীতে তার চাচাতো মামা মরহুম মোহাম্মদ আলী ফারুক তালুকদার এবং মামী, বাকেরগঞ্জের সাবেক আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ শাহনাজ পারভীন মায়া (এমপি), পারিবারিক সম্পর্কের কারণে তাকে ঢাকার প্রীতি গ্রুপে চাকরি দেন। সেখানে আত্মীয়তার সুযোগ নিয়ে তিনি কয়েক বছর চাকরি করেন এবং অভিযোগ অনুযায়ী কোটি টাকার জমি ও অর্থ প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেন। প্রতারণা ধরা পড়লে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে এবং চাকরি থেকে বহিষ্কার করেন।
পরে বিষয়টি মাহমুদ আল জামানের বাবা-মায়ের কানে পৌঁছালে তারা তাদের আত্বীয় প্রীতিগ্রুপের চেয়ারম্যান ফারুক তালুকদার, তার স্ত্রী মায়া তালুকদার এবং ছেলে—বাকেরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান রাজিব তালুকদারের কাছে গিয়ে ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিষয়টি মীমাংসা হয়। এরপর পবিপ্রবির প্রো ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড এসএম হেমায়েত জাহান এর মাধ্যমে পূর্বে ছাত্রদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা উল্লেখ করে একটি জোর সুপারিশপত্র প্রদান করা হয় এবং তার ভিত্তিতে মাহমুদ আল জামান বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী রেজিস্ট্রার (খণ্ডকালীন) পদে নিয়োগ পান।
মাহমুদ আল জামানের ছোট ভাই রাজিব খান পবিপ্রবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ছিলেন। ছাত্রলীগের নেতৃত্বের সুবাদে তিনি পুলিশে সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) পদে চাকরি লাভ করেন এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই পদোন্নতি পেয়ে অফিসার ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে গত জুলাই মাসে গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবের পর তাকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে রাজিব খান বিএনপি-জামায়াতের অসংখ্য নেতাকর্মীর উপর চরম নৃশংস নির্যাতন চালিয়েছেন। এসব ঘটনার কারণে স্থানীয়ভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মাহমুদ আল জামান বিবাহ করেছেন দুমকির আওয়ামী লীগ নেতা ও চাচা মো. আব্দুর রব খানের বড় মেয়েকে। তার মেঝ শালিকা বিবাহিত হয়েছেন পবিপ্রবি ছাত্রলীগের সাবেক ক্যাডার, বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা এবং বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টাডিজ ডিন অফিসের ডেপুটি রেজিস্ট্রার তানজিলুর রহমান তানজিলের সঙ্গে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাহমুদ আল জামানের পরিবারের কারও সঙ্গে বিএনপি রাজনীতির কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, যোগদানের পর থেকেই তিনি বিভিন্ন সময় আচরণবিধি লঙ্ঘন করে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন, যা প্রশাসনিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এসব কারণে কর্মকর্তাদের মাঝে তার প্রতি তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত সহকারী রেজিস্ট্রার (খন্ডকালীন) মাহমুদ আল জামান বলেন, আমার আজকের মন মানুষিক অবস্থা ভালো ছিলনা তাই সেকশন অফিসার সাকিন রহমানের সঙ্গে আমার কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে চড়থাপ্পড় মেরে ফেলি আমার ভুল হয়েছে। ভবিষ্যতে এরকম আর হবেনা।
এ বিষয়ে পবিপ্রবির ভিসি ড. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন,“ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনোভাবেই বরদাশত করবে না। তদন্ত কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রো ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এস. এম. হেমায়েত জাহান বলেন,“কর্মস্থলে সহকর্মীর সঙ্গে শারীরিক বা মানসিক আক্রমণ গুরুতর অপরাধ। আমরা চাই, বিষয়টি দ্রুত তদন্ত শেষ করে সবার সামনে সত্য তুলে ধরা হোক।”
রেজিস্ট্রার (অ: দা:) অধ্যাপক ড. মো: ইকতিয়ার উদ্দিন বলেন, “এই ধরনের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। আশা করছি তদন্ত কমিটি নিরপেক্ষভাবে ঘটনা উদঘাটন করবে।”
শিক্ষার্থীদের দাবি, ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের একাংশ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে এবং লিখিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে মাহমুদ আল জামানের চাকরিচ্যুতির দাবি জানায়। তাদের ভাষায়, “বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অসামাজিক ও অসৌজন্যমূলক আচরণের কোনো স্থান নেই। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।