৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

এক আপসহীন চিন্তাযোদ্ধা বদরুদ্দীন উমরের প্রস্থান

নিজস্ব প্রতিনিধি:

লেখক, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বামপন্থি রাজনীতিক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর আর নেই (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। রোববার সকাল ১০টা ৫ মিনিটে রাজধানীর শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, প্রায় এক মাস ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন এবং একাধিকবার তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল। রোববার সকালে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়া হয়, তবে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন। ছোট মেয়ে সারা আকতার তার সেবাযত্ন করতেন, আর বড় মেয়ে লন্ডনে থাকেন এবং আজই তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

তার ছেলে সোহেল আব্দুল্লাহ জানান, সোমবার সকাল ১০টায় বদরুদ্দীন উমরের লাশ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে, যাতে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। পরে জুরাইন কবরস্থানে দাদার কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে। এর আগে রোববার দুপুরে লাশ ফ্রিজিং গাড়িতে করে তার বাসায় নেওয়া হয়।

১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর ভারতের বর্ধমানে জন্ম নেওয়া বদরুদ্দীন উমর ছিলেন খ্যাতনামা মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতা আবুল হাশিমের সন্তান। ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে তার লেখাগুলো স্বাধীনতা সংগ্রামে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৬), ‘সংস্কৃতির সংকট’ (১৯৬৭), ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৯), ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক’, ‘যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ’ ইত্যাদি।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে পিপিই ডিগ্রি অর্জনের পর দেশে ফিরে তিনি ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে রাজনীতি ও লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভাষা আন্দোলনের ওপর তার লেখা ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ ছিল প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ। আজীবন আপসহীন এই চিন্তাবিদ স্বাধীনতার পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।

তিনি বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী এবং একসময় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ২০০৩ সালে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল গঠন করে সভাপতির দায়িত্ব নেন।

তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। শোকবার্তায় তিনি বলেন, বদরুদ্দীন উমর ছিলেন মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতির সংগ্রামের উজ্জ্বল বাতিঘর। ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা, গবেষণা ও সমাজতান্ত্রিক দর্শনের প্রতি নিষ্ঠা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।

শোক জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার, আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলমসহ অনেকেই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শোকবার্তায় তাকে রাজনৈতিক জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-সিপিবি (এম)-এর সভাপতি কমরেড ডা. এম এ সামাদ ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড সাহিদুর রহমানও তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top