১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২১শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

কোটি টাকার উদ্ধারকারী নৌকা অকেজো—অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে সরকারি সম্পদ

মো. সাইফুল ইসলাম, নীলফামারী প্রতিনিধি:

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার সীমান্তবর্তী তিস্তা নদীর ভয়াবহ বন্যায় প্রাণ রক্ষা ও ত্রাণ কার্যক্রমে ব্যবহারের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোটি টাকারও বেশি মূল্যের দুটি উদ্ধারকারী নৌকা (রেসকিউ বোট) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এর একটি রাখা হয় খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের পাগলপাড়া এলাকায় এবং অন্যটি ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের ডনের সাইড ঘাটে। কিন্তু দীর্ঘদিনের অবহেলা, অযত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নৌকাগুলো এখন প্রায় ধ্বংসের পথে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে একটি এবং ২০২১ সালে আরেকটি উদ্ধারকারী নৌকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতিটি নৌকার দাম এক কোটি টাকারও বেশি। ৫৪ ফুট দৈর্ঘ্য, ১২.৫ ফুট প্রস্থ ও ৮০ জন যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এ নৌযানগুলো ঘণ্টায় ৭ নটিক্যাল মাইল গতিতে চলতে সক্ষম। বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া ও ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এগুলো ব্যবহারের কথা থাকলেও বাস্তবে বছরের পর বছর এগুলো অকেজো অবস্থায় নদীর তীরে পড়ে আছে।

সরকারি নথি অনুযায়ী প্রতিবছর নৌকাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি ও রং করার জন্য অর্থ বরাদ্দ থাকে। তবে স্থানীয় সূত্র বলছে, বাস্তবে কোনো কাজই হয়নি। বরং খাতায় টাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা থাকলেও তা কার্যকর হয়নি। অথচ নৌকার ক্রু ও সহকারী মিলে তিনজন নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছিলেন, যার পরিমাণ বছরে কয়েক লাখ টাকা। তবে গত ১০ মাস ধরে তাদের বেতনও বন্ধ রয়েছে।

পাগলপাড়া গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রহিম অভিযোগ করে বলেন, “গত দুই-তিন বছরে নৌকা দুটির রক্ষণাবেক্ষণ ও ক্ষুদ্র মেরামতের জন্য প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কোনো কাজ হয়নি। সব টাকাই অজানা খাতে চলে গেছে।”

তিস্তাপাড়ের কৃষক আজিজুল ইসলাম বলেন, “বন্যার সময় আমরা ভেবেছিলাম নৌকাগুলো দিয়ে মানুষকে সরানো হবে। কিন্তু এখন এগুলো অচল অবস্থায় পড়ে আছে। এটি আমাদের জন্য লজ্জাজনক।”

ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একরামুল হক চৌধুরী বলেন, “সরকার মানুষের জীবন বাঁচাতে নৌযান দিয়েছে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবহেলায় এগুলো অকেজো হয়ে যাচ্ছে। আমরা একাধিকবার বিষয়টি জানিয়েছি। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে কোটি টাকার সরকারি সম্পদ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে।”

ডিমলা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. আশরাফুল ইসলাম স্বীকার করে বলেন, “নৌকাগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহার হচ্ছে না, এটা সত্যিই দুঃখজনক। আমরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়েছি। শিগগিরই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নৌকাগুলো সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরানুজ্জামান জানান, “নৌকাগুলো আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো অচল অবস্থায় থাকা সত্যিই হতাশাজনক। আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখব এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা করব।”

নীলফামারী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “আমি ২০২৫ সালের ৫ জানুয়ারি এই দপ্তরে যোগদান করেছি। এর আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারাই বিষয়টি ভালো জানবেন। এরপর থেকে এ খাতে কোনো নতুন বরাদ্দ আসেনি। যেহেতু এটি একটি সরকারি সম্পদ, তাই রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।”

প্রতিবছর তিস্তার ভাঙন, বন্যা ও নদীপাড়ের মানুষের দুর্ভোগে ডিমলা উপজেলা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্থানীয়দের দাবি, উদ্ধারকারী নৌকাগুলো সচল থাকলে বর্ষায় অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণহানি ও জানমালের ক্ষতি অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হতো। তাই তারা দ্রুত নৌকাগুলো মেরামত ও নিয়মিত ব্যবহারের দাবি জানিয়েছেন।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top