৯ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৭ই রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

চাঁপাইনবাবগঞ্জে খেলার মাঠ দখল করে হোটেল-রেস্তোরা, বাজার বসিয়ে চাঁদাবাজি

মোঃ তুহিন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি:

চাঁপাইনবাবগঞ্জের বারোঘরিয়ায় সরকারি দৃষ্টিনন্দন পার্ক ও খেলার মাঠ দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে হোটেল-রেস্তোরা ও দোকানপাট। দখল-দূষণে কয়েক বছর ধরে বন্ধ হয়েছে খেলাধূলা। খেলার মাঠ দখলের পর এখন নিয়মিত বসছে মাদক ও জুয়ার আসর। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল বাজার বসিয়ে প্রতিনিয়ত করছে চাঁদাবাজি। বারবার উচ্ছেদ অভিযানেও বন্ধ হয়নি দখলদারদের দৌরাত্ম।

জানা যায়, গত ২০২৪ সালের ০৫ আগস্ট আ.লীগ সরকারের পতনের দিন খেলার মাঠ দখল করে থাকা বিভিন্ন স্থাপনা উচ্ছেদ করে আনন্দ-উল্লাস করে তরুণ-যুবকরা। দীর্ঘদিন পর দখল হওয়া খেলার মাঠ উদ্বার করতে পেরে “খেলা হবে, খেলা হবে” স্লোগান দিতে থাকে ছাত্র-জনতা। কিন্তু তাদের এই আনন্দ স্থায়ী হয়নি বেশিদিন। সরকার পতনের কয়েক মাসের মধ্যেই আবারো চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার বারোঘরিয়ায় মহানন্দা নদীর ধারের সেই সরকারি পার্ক ও খেলার মাঠ দখল করে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে হোটেল-রেস্তোরা ও দোকানপাট।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, যুগ যুগ ধরে বারোঘরিয়া দৃষ্টিনন্দন পার্ক ও খেলার মাঠে হয়ে আসছে ক্রিকেট ও ফুটবলের টুর্ণামেন্ট। কিন্তু গত ৩ বছর ধরে মাঠ দখল করে শতাধিক দোকানপাট, হোটেল নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বাজার। সন্ধ্যার পর উচ্চস্বরে মাইক আর আলোর ঝলকানিতে আরও জমজমাট হয় এই বাজার। খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হয়ে এলাকার তরুণ-যুবকরা মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলে দাবি স্থানীয়দের।

অভিযোগ রয়েছে, খেলার মাঠে অবৈধভাবে গড়ে তোলা বাজার থেকে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল নিয়মিত চাঁদাবাজি করে। প্রত্যেক দোকান থেকে দৈনিক ৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। এসব দোকান ও হোটেল স্থাপনের সময় নেয়া হয়েছে ৪-১৫ হাজার টাকা। বাজারে সন্ধ্যা হলেই বসে জুয়া ও মাদকের আসর। দফায় দফায় প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলেও আবারো বসে বাজার।

স্থানীয় যুবক ফয়সাল আজম বলেন, আমরা দীর্ঘকাল ধরে এই মাঠে ক্রিকেট ফুটবল খেলে আসছি। দৃষ্টিনন্দন পার্কের জায়গা হিসেবে উপজেলা প্রশাসন নদীর ধারে বসার জায়গাসহ বেশকিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে। মাঠ সবসময়ই ফাঁকা থেকেছে। কিন্তু গত ৩ বছর ধরে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল দৃষ্টিনন্দন পার্ক ও খেলার মাঠ দখল করে মেলা বসিয়েছে। তখন থেকেই এই এলাকার হাজার হাজার তরুণ-যুবক খেলাধূলা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়ে গেছে।

কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান জানান, এখানে প্রতিবছর ফুটবল ও ক্রিকেট টুর্ণামেন্ট হতো। জমজমাট আয়োজন হতো দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু দখল করে মেলা বসানোর পর থেকেই তা আর হয়নি। এখানে পলিটকনিক ইন্সটিটিউট ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কয়েক হাজার ছাত্রের জন্য এই খেলার মাঠ ছিল আর্শিবাদ। কিন্তু এখন তা অভিশাপে পরিনত হয়েছে। প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত উচ্চস্বরে চলে মাইকে গানবাজনা। এতে দৃষ্টিনন্দন পার্কের আশেপাশে থাকা কয়েক হাজার শিক্ষার্থী পড়েছে চরম ভোগান্তিতে।

ষাটোর্ধ তরিকুল ইসলাম বলেন, প্রশাসন কয়েক দফায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে দখলমুক্ত করলেও আবারো দখল হয়ে যায়। শুনেছি, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করেই এখানে দৈনিক চাঁদাবাজি করা হয়। দৈনিক লাখ টাকা চাঁদা তুলা হলেও সকলেই নিরব। এনিয়ে দফায় দফায় অভিযোগ দিলেও অবৈধভাবে গড়ে তোলা মেলার দোকানপাট, বাজার ও নদীতে থাকা ভাসমান রেস্টুরেন্ট নিয়ে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শাহনেয়ামতুল্লাহ কলেজর এক ছাত্র সময় সংবাদকে বলেন, গতবছরের ০৫ আগস্ট স্বৈরাচারমুক্ত হওয়ার দিন এই মাঠও দখলমুক্ত করে ছাত্র-জনতা। আমরা সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে খেলাধুলার ব্যবস্থা করি। কিন্তু তার কয়েক মাস যেতে না যেতেই পুনরায় দখল হয় দৃষ্টিনন্দন পার্ক ও খেলার মাঠ। তরুণ শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা বিনোদন ও শারীরিকভাবে ঠিক রাখতে এই মাঠ উদ্বারের কোন বিকল্প নেই। অবিলম্বে এই চাঁদাবাজি বন্ধ ও দখল হওয়া মাঠ উদ্বার না করলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলেও হুশিয়ারি দেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই নেতা।

এনিয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি দখলদার ও চাঁদা আদায়কারী কেউই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দাবি, খেলার মাঠ দখল করে বাজার তৈরি হওয়ায় সেখানে প্রতিনিয়ত ঘটছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, অবনতি হয়েছে পরিবেশ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির। বারোঘরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশীদ বলেন, এটি আমাদের এখতিয়ার বর্হিভূত। কারন এর আগে এনিয়ে কাজ করতে গেলে আমাদেরকে বাধা দেয়া হয়। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, সরকারি দৃষ্টিনন্দন পার্ক ও খেলার মাঠ দখল হওয়ায় এখানে প্রতিনিয়ত নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটছে। নিয়মিত এখানে বসে মাদকের আড্ডা ও কেনাবেচা। বিরাট বিরাট রাইড ও খাবারের দোকান বসিয়ে নষ্ট করা হচ্ছে নদী ও নদীপাড়ের পরিবেশ। সরকারি পার্ক ও খেলার মাঠ দখলমুক্ত করতে দ্রুত সময়ের মধ্যে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার দাবি জানান তিনি।

উচ্ছেদের পাশাপাশি দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা করার হুশিয়ারী স্থানীয় প্রশাসনের। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, সরকারি পার্ক ও পার্কের মধ্যে থাকা খেলার মাঠ দখল করে অবৈধভাবে বাজার ও মেলা বসানোর বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এবার কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে প্রশাসন। উচ্ছেদের পাশাপাশি দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে বলেও জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, গতবছরের ২৩ জুলাই রাতে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে সরকারি পার্ক ও খেলার মাঠ থেকে স্থায়ী, অস্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ মিলে শতাধিক দোকান উচ্ছেদ করে প্রশাসন।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top