নিজস্ব প্রতিনিধি:
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র তিন মাস বাকি। প্রধান উপদেষ্টা একাধিকবার জানিয়েছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে রাজনীতির মাঠ এখন সম্পূর্ণভাবে নির্বাচনমুখী। আসনভিত্তিক সমাবেশ, প্রচারণা ও গণসংযোগে ব্যস্ত দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। ঠিক এই সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় এসেছে নতুন একটি শব্দ—‘সেফ এক্সিট’।
এই আলোচনার সূত্রপাত ঘটে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আহ্বায়ক ও সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের এক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। তিনি বলেন, “উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছেন। তারা এখন নিজেদের সেফ এক্সিট বা নিরাপদ প্রস্থান নিয়ে ভাবছেন।”
তার এই বক্তব্য মুহূর্তেই রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। টেলিভিশনের টকশো থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক বিতর্ক। অনেক রাজনৈতিক দল বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসেছে। এমনকি সরকারের ভেতরেও এই মন্তব্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, নাহিদ ইসলাম একসময় সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বর্তমানে বিরোধী অবস্থানে থাকলেও ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। ফলে তার মুখ থেকে এমন মন্তব্য আসা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
এক সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, “উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছেন। তারা নিজেদের নিরাপদ প্রস্থানের কথা ভাবছেন। এটা আমাদের অনেক ভোগাতে হচ্ছে এবং আরও ভোগাতে হবে। কিন্তু তারা যদি বিশ্বাস করতেন যে তাদের নিয়োগদাতা ছিলেন গণঅভ্যুত্থানের শক্তি, রাজপথে জীবন দেওয়া ও আহত সাধারণ মানুষজন, তাহলে এই বিচ্যুতি ঘটত না।”
নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্যের পর এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম আরও কঠোর মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “কিছু উপদেষ্টা দায়সারা দায়িত্ব পালন করছেন। তারা শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে কোনোভাবে বেরিয়ে যেতে চান, দেশে থাকুন বা বিদেশে। এই দায়সারা মনোভাবের জন্য অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। শহীদের রক্তের ওপরে দাঁড়িয়ে যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা যদি এমন চিন্তা করেন, তাহলে দেশের মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারবেন না। যারা সেফ এক্সিটের চিন্তা করছেন, তাদের জন্য মৃত্যু ছাড়া কোনো নিরাপদ পথ নেই।”
এনসিপির পক্ষ থেকে পরে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়—তারা সরকারের ব্যর্থতা ও কিছু উপদেষ্টার আর্থিক অনিয়মের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। দলের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, তাই ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গ এসেছে।
অন্যদিকে সরকারপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক নেতা উপদেষ্টাদের কিছু বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগ, কিছু উপদেষ্টা হয়তো ক্ষমতার মেয়াদ বাড়াতে চান এবং নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি নিজেরাও নিরাপদ অবস্থানে থাকতে চাইছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী বলেন, “ইউনূস সরকারের নানা ভুলের কারণে জনগণ অভ্যুত্থানের সুফল পায়নি। এসব ব্যর্থতার কারণেই নির্বাচনের আগে উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিট প্রসঙ্গ সামনে এসেছে।”
এদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বুধবার (৮ অক্টোবর) নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, “উপদেষ্টাদের মধ্যে কারা সেফ এক্সিট নিতে চান, সেটি নাহিদ ইসলামকেই পরিষ্কার করতে হবে। তিনি যদি তা ব্যাখ্যা করেন, তখন সরকার এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে পারে। এর আগে সরকারের পক্ষে কিছু বলার সুযোগ নেই।”
তিনি আরও বলেন, “নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সরকারের একটি ভালো কাজের সম্পর্ক রয়েছে। নাহিদ ইসলাম অভিমান বা ব্যক্তিগত অসন্তোষ থেকে এ কথা বলেছেন কি না, তা তাকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। বক্তব্যটি সুনির্দিষ্ট নয় বলে সরকারের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ার প্রয়োজন নেই।”
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান স্পষ্ট করে বলেন, “আমি কোনো এক্সিট খুঁজছি না। আমি দেশেই ছিলাম, আগেও বহু ঝড়ঝঞ্ঝা এসেছে—সবকিছু মোকাবিলা করে এখানেই থেকেছি। বাকিটা জীবনও বাংলাদেশেই কাটাব।”
নাহিদ ইসলামের বক্তব্য নিয়ে সরকারের ভেতরে আলোচনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলের নেতারা বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিনিয়ত মন্তব্য করেন, এটি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। প্রতিটি বিষয়ে যদি সরকার প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে, তাহলে প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে। যখন কোনো বিষয় আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে, তখন সরকার অবশ্যই সে বিষয়ে বক্তব্য দেবে।”