আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে দমননীতি জোরদার হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বহু মুসলিম পুরুষকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ এবং তাদের কয়েকজনের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গত মাস থেকে শুরু হওয়া এই অভিযানের মূল কারণ একটাই— পোস্টার, টি-শার্ট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখা ‘আই লাভ মুহাম্মদ’, যা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বলছে, এই অভিব্যক্তি ‘জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি’।
অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস (এপিসিআর) জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ২২টি মামলায় ২,৫০০ জনেরও বেশি মুসলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে এবং অন্তত ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই বিজেপি-শাসিত রাজ্যের বাসিন্দা।
ঘটনার সূত্রপাত গত ৪ সেপ্টেম্বর ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুর শহরে। নবীজির জন্মবার্ষিকী ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে মুসলিমরা এক বোর্ড টানান, যেখানে লেখা ছিল ‘আই লাভ মুহাম্মদ’। কিছু স্থানীয় হিন্দু অভিযোগ করেন, এটি নতুন সংযোজন, যা স্থানীয় আইনে নিষিদ্ধ। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ দুই ডজন মুসলমানের বিরুদ্ধে ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ানোর মামলা করে।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কানপুর ছাড়াও তেলেঙ্গানা, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, উত্তরাখণ্ড ও জম্মু-কাশ্মীরসহ বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কানপুর থেকে ২৭০ কিলোমিটার দূরে বেরেলিতে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের পর এক ইমামসহ ৭৫ জনকে গ্রেফতার করে এবং অভিযুক্তদের চারটি ভবন বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
ভারতের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চয়তা দেয়। সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের তার ধর্ম পালন ও প্রকাশের অধিকার আছে, এবং ১৯(১)(ক) অনুচ্ছেদে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে—যতক্ষণ না তা সহিংসতা বা ঘৃণা উসকে দেয়।
এপিসিআর-এর জাতীয় সমন্বয়ক নাদিম খান বলেন, কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন আইনের আশ্রয় নিচ্ছে, যা সরাসরি ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বাক্যটিকে অপরাধ ঘোষণা না করলেও অন্য অভিযোগে মুসলিমদের ফাঁসানো হচ্ছে। তিনি বলেন, “তারা জানে, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলা কোনো অপরাধ নয়— এমন কোনো আইনই নেই।”
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার বোর্ড চেয়ারম্যান আকার প্যাটেল বলেন, “‘আই লাভ মুহাম্মদ’-এর মতো শান্তিপূর্ণ অভিব্যক্তিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী। রাষ্ট্রের ভূমিকা হওয়া উচিত নাগরিকদের সমান অধিকার রক্ষা করা, বিশ্বাসের প্রকাশ দমন নয়।”
সমালোচকদের মতে, এই অভিযানটি মুসলিমদের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে চলমান বৈষম্য ও প্রান্তিকীকরণের ধারাবাহিকতা। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে ভারতে ঘৃণাত্মক বক্তব্যের ঘটনা ছিল ৬৬৮টি, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১,১৬৫টিতে। এসব ঘটনার বড় অংশই বিজেপি-শাসিত রাজ্যে সংঘটিত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিম আলি বলেন, “এখন ঘৃণার প্রচার একটি কাঠামোগত রূপ নিয়েছে— অনুগত গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যন্ত।” তিনি আরও জানান, কানপুরের ঘটনায় বিজেপি নেতারা বারাণসীতে ‘আই লাভ বুলডোজার’ লেখা পোস্টার টানিয়ে মুসলিমদের ঘরবাড়ি ভাঙার ঘটনাকে সমর্থন জানিয়েছে।
বিশ্লেষক রশিদ কিদওয়াই মনে করেন, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ইস্যুটি মূলত রাজনৈতিক, ধর্মীয় নয়। তরুণ মুসলমানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান হতাশা দেখা দিচ্ছে, কারণ তারা বুঝতে পারছে একই নিয়ম সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। এপিসিআর-এর তথ্যমতে, গ্রেফতার হওয়া অধিকাংশই তরুণ মুসলিম, যাদের অনেকেই শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেওয়ার কারণে আটক হয়েছেন।
আসিম আলি সতর্ক করে বলেন, “‘আই লাভ মুহাম্মদ’-এর মতো অভিব্যক্তির ওপর দমননীতি তরুণ মুসলমানদের আরও বিচ্ছিন্ন করছে। ভবিষ্যতে এই ঘৃণার স্রোত কোথায় গিয়ে থামবে, তা এখনই বলা কঠিন।”