মোঃ সাজেল রানা, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি
গত পরশু মিরপুরের একটি গার্মেন্টসের কেমিক্যাল ইউনিটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছে একাধিক শ্রমিক। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা অন্তত ১৬ জন বলে জানা গেলেও, বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রচার অত্যন্ত সীমিত। যেখানে ১৬টি তাজা প্রাণ ঝরে গেল, সেখানে জাতীয় মিডিয়া যেন এক অশিক্ষিত কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের পারিবারিক সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত। টিভি চ্যানেলগুলোর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বরাদ্দ ওই কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের পারিবারিক সম্পর্ক ও সমস্যা বিশ্লেষণে।
অথচ এই অগ্নিকাণ্ডে নিহত নব বিবাহিত তরুণ-তরুণী বা অসহায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির কোনো পরিসংখ্যান বা তাদের জীবনের মূল্য নিয়ে কোনো আলোচনা নেই।
এই প্রবণতা আবারও প্রমাণ করে যে সংবাদমাধ্যম এখন জনস্বার্থের পরিবর্তে কেবলই ‘পাবলিসিটি’ ও ‘ভিউ’-এর পেছনে ছুটছে। কোনো সেলিব্রিটির পোশাক, দেবর-ভাবীর প্রেম, বা একাধিক বিবাহ—এই ধরনের মুখরোচক শিরোনাম ছাড়া এদের ভিউ কমে যায়। একটি ভয়াবহ ট্র্যাজেডি যেখানে মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়েছে, সেখানে সংবাদমাধ্যমের এই ‘নির্বাচিত প্রচার’ সমাজের সংবেদনশীলতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে।
মিরপুর ট্র্যাজেডিতে কার কত লাভ?
এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ও দায়বদ্ধতার দিকটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
১. মালিক পক্ষ: এত বড় একটি পোশাক কারখানার নিশ্চিতভাবেই অগ্নি বীমা (ফায়ার ইন্স্যুরেন্স) করা থাকে। ফলে, সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে মালিক পক্ষের আপাত ক্ষতি হয়তো ‘ক্ষীণ’ হতে পারে। কিন্তু যে ১৬টি শ্রমিকের জীবন গেছে, সেই জীবনের মূল্য মালিক পক্ষের কাছে কতটুকু?
২. সন্দেহ ও জল্পনা: এমন উদ্বেগও সৃষ্টি হয়েছে যে অনেক সময় মালিক পক্ষ নিজেরাই বীমার টাকা উসুল করার জন্য শ্রমিকদের আটকে রেখে আগুন ধরিয়ে দেয় কি না। অতীতেও এমন গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। শ্রমিক নিরাপত্তা ও জীবনরক্ষার ক্ষেত্রে এই ধরনের সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে সচেতন মহল।
৩. রাজনৈতিক ফায়দা: রাজনৈতিকভাবেও এই ট্র্যাজেডির প্রফিট রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এখন নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর নাম করে নিজেদের অবস্থান তৈরি এবং ভোটের বাজারে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করবে। শোককে শক্তিতে রূপান্তরের স্লোগানে ঢাকা পড়ে যেতে পারে মূল দায়বদ্ধতার প্রশ্ন।
অজানা জীবনগুলোর হিসাব কে দিবে?
লাভ-ক্ষতির এই হিসাবে, সবচেয়ে বড় ক্ষতি যা অপূরণীয়, তা হলো ১৬টি তাজা প্রাণ। নিহতদের মধ্যে কতজন ছিল সদ্য বিবাহিত তরুণ-তরুণী, কতজন ছিল তাদের পুরো পরিবারের একমাত্র অবলম্বন—সেই হিসাব কেবল তাদের পরিবার জানে।
এই ঘটনা কেবল একটি অগ্নিকাণ্ড নয়, এটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, মালিক পক্ষের উদাসীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের সংবেদনহীনতার প্রতীক। কত প্রাণ গেল তার হিসাব কে দেবে? কে দেবে ওই নব্য বিবাহিত তরুণ-তরুণীর জীবনের মূল্য? কে দেবে ওই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির জীবনের মূল্য? প্রশ্নগুলো ঝুলন্ত, উত্তর অনিশ্চিত।
সমাজের প্রতিটি স্তরে, বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমকে, এই মানবিক ট্র্যাজেডির গুরুত্ব অনুধাবন করে তার সঠিক প্রচার করা এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে সোচ্চার হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
অন্যায়-অনুসন্ধান-বাস্তবতাঃ ১ম পর্ব(ধারাবিক)