৪ঠা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৯শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৩ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

বিদ্যালয়ের ভেতরেই অনিরাপদ ছাত্রী: প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অশ্লীল বার্তার অভিযোগ

মো. সাইফুল ইসলাম, নীলফামারী প্রতিনিধি:

দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে ক্রমেই বাড়ছে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের যৌন হয়রানি, অশোভন আচরণ ও অনৈতিক প্রস্তাবের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় অভিভাবকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

একসময় বিদ্যালয় ছিল জ্ঞানের মন্দির ও নিরাপত্তার প্রতীক। কিন্তু আজ সেই মন্দিরের ভেতরেই যখন শিক্ষকই পরিণত হচ্ছেন ভয় ও অবিশ্বাসের উৎসে, তখন কেঁপে ওঠছে সমাজের বিবেক। শিশুরা যেখানে দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা পাওয়ার কথা, সেখানে এখন তারা পাচ্ছে ভয়, লজ্জা ও মানসিক আঘাত।

এমনই এক ঘটনা ঘটেছে নীলফামারীর ডোমার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. দুররুল আনাম ছিদ্দিকীর বিরুদ্ধে একাধিক ছাত্রীকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ ও অশ্লীল মেসেজ পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে।

জানা যায়, প্রধান শিক্ষক বিভিন্ন সময়ে বিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রীকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে অশোভন বার্তা পাঠান। এতে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী জানায়, “স্যার প্রথমে সাধারণভাবে কথা বলেন, পরে অশোভন ও লজ্জাজনক কথায় চলে যান। ভয় ও লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পারিনি।”
আরেকজন ছাত্রী বলেন, “স্যার ফেসবুকে ‘কি করো’ বলে কথা শুরু করেন, তারপর অশ্লীল কথা বলেন। এজন্য আমি তাকে ব্লক করে দিয়েছি।”

অভিভাবকদের একাংশ বলছেন, এমন ঘটনায় মেয়েদের স্কুলে পাঠানো নিয়েই তারা এখন শঙ্কিত। আনোয়ার হোসেন নামে এক অভিভাবক বলেন, “আমরা মনে করতাম মেয়েরা স্কুলে নিরাপদ। কিন্তু প্রধান শিক্ষক যদি নিজেই এমন আচরণ করেন, তাহলে বিশ্বাস রাখব কোথায়? তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।”

ডোমার উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী আসমাউল হাসান বলেন, “বিদ্যালয়ে শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এই ধরনের ঘটনা শুধু ভুক্তভোগীদের মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং পুরো শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করে।”

এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক মো. দুররুল আনাম ছিদ্দিকী বলেন, “আমি নিজের ভুল স্বীকার করেছি এবং ছাত্রীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছি। ভবিষ্যতে এমন হবে না।”

ডোমার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সায়শা সাঈদ তন্নী বলেন, “বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অন্যদিকে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা রংপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোছা. রোকসানা বেগম জানিয়েছেন, “বিষয়টির সত্যতা যাচাই করে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

শিক্ষাবিদ ও নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির এই ধারাবাহিকতা কেবল কয়েকজন ব্যক্তির নয়, এটি একটি সামাজিক সংকটে রূপ নিচ্ছে। শিক্ষকতা একটি পবিত্র পেশা—এখানে নৈতিক অবক্ষয় মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নৈতিক ধ্বংস।

তাদের মতে, নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রা রক্ষা করতে হলে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা, শিক্ষক নিয়োগে নৈতিক যাচাই, এবং হয়রানির ঘটনায় দ্রুত ও কঠোর আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

কারণ, শিক্ষক যদি ভয়ের প্রতীকে পরিণত হন, তবে শিক্ষা হবে নির্যাতনের প্রতীক—আর তখন সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top