১০ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৯শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

প্রাথমিক শিক্ষা, দায়সারা মনোভাব, মানহীন পাঠদান শিক্ষক সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ?

মোঃ আমিরুল হক, রাজবাড়ী প্রতিনিধি:

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাত বর্তমানে এক গভীর সংকটে পড়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতা, টিউশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়া এবং আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে দাবী আদায়ের সংস্কৃতি,সব মিলিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

বর্তমানে গ্রামাঞ্চল থেকে শহর পর্যন্ত অভিভাবকদের মধ্যে একটি স্পষ্ট প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তারা সন্তানদের সরকারি বিদ্যালয়ের পরিবর্তে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করছেন। এমন কি সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের সন্তানকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াচ্ছেন।

অভিভাবকদের অভিযোগ, সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা নিয়মিত উপস্থিত থাকলেও পাঠদানে আন্তরিকতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। অনেক শিক্ষক ক্লাস নিলেও কেবল রুটিন পূরণের জন্য দায়সারা দায়িত্ব পালন করেন।

বিষয়টি আরও উদ্বেগজনক হলো—সরকারি বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক নিজের সন্তানের শিক্ষার জন্যও সরকারি বিদ্যালয়ের পরিবর্তে কিন্ডারগার্টেন বেছে নিচ্ছেন। এতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতি জনগণের আস্থা আরও কমছে।

সরকারি সুবিধা বাড়লেও শিক্ষার মান কমেছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে।

গত কয়েক বছরে সরকার প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য বেতন ও পদোন্নতির কাঠামোয় বড় পরিবর্তন এনেছে। বর্তমানে সহকারী শিক্ষকদের জন্য ১৩তম গ্রেড, প্রধান শিক্ষকদের জন্য ১১তম ও ১০ম গ্রেড নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অতিরিক্ত ভাতা ও ভবিষ্যতে আরও সুবিধার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। তবুও শিক্ষার মানোন্নয়ন হয়নি বরং অনেক বিদ্যালয়ে ফলাফল ও উপস্থিতি দুই-ই নিম্নমুখী। শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার সুবিধা দিলেও তার বিনিময়ে শিক্ষকেরা প্রত্যাশিত মানসিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা দেখাচ্ছেন না।

দায়সারা পাঠদান ও টিউশন বাণিজ্যের অভিযোগে, স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অনেক শিক্ষক বিদ্যালয়ের বাইরেও টিউশন বা কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে বিদ্যালয়ে পাঠদানের সময় আন্তরিকতা ও মনোযোগ কমে যাচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা বলছে—“স্কুলে স্যার/ম্যাডাম ভালো করে পড়ান না, পরে বাসায় টিউশন নিতে বলেন।”
এই প্রবণতা কেবল নৈতিক অবক্ষয়ই নয়, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যও বাড়িয়ে তুলছে।”

সুশীলসমাজ বলছেন, আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে দাবি আদায়, সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আবারও দাবি আদায়ের আন্দোলনে নেমেছেন এমন সময়টা শিক্ষাবর্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়, বৃত্তি পরীক্ষা ও তৃতীয় প্রান্তিক মূল্যায়নের ঠিক আগে।
ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে, অভিভাবকরা পড়ছেন চরম দুশ্চিন্তায়।

শিক্ষাবিদদের মতামত “শিক্ষকরা যদি নিজের দাবি আদায়ের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থামিয়ে দেন, তাহলে সেটি দায়বোধের নয়, বরং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎকে জিম্মি করার নামান্তর।

শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, অনেক শিক্ষক এখন তদারকিকে “হস্তক্ষেপ” হিসেবে দেখেন। কেউ নিয়ম মেনে কাজ করতে বললে, তার বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে।
ফলে যারা আন্তরিকভাবে কাজ করতে চান, তারাই সহকর্মীদের কাছে ‘কঠোর’ বা ‘অপ্রিয়’ হয়ে পড়েন। এতে নৈতিক শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।

শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মতে, প্রাথমিক শিক্ষায় উন্নতি ঘটাতে হলে আগে শিক্ষক সমাজকে আত্মসমালোচনার পথে ফিরতে হবে।
একজন শিক্ষক কেবল সরকারি কর্মচারী নন—তিনি জাতি গঠনের কারিগর। তাই তাঁর আন্দোলন হওয়া উচিত শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষার্থীর উন্নতি ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য।
কিন্তু বাস্তবে আন্দোলনগুলো এখন অনেকাংশে ব্যক্তিগত আর্থিক সুবিধা অর্জনের রূপ নিচ্ছে, যা শিক্ষক সমাজের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

প্রাথমিক শিক্ষা কোনো চাকরি নয়, এটি একটি দায়িত্ব, একটি জাতিগত অঙ্গীকার।
এই অঙ্গীকার ভঙ্গ হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো জাতি। তাই এখন সময় এসেছে শিক্ষকদের নতুন করে দায়বোধ জাগানোর, আন্দোলনের পরিবর্তে আত্মসমালোচনা ও শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক মানোন্নয়নের পথে ফেরার।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top