মো. সাইফুল ইসলাম, নীলফামারী প্রতিনিধি:
দেশজুড়ে ভুয়া সাংবাদিকতার বিস্তার ক্রমশ উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। ক্যামেরা, মোবাইল ফোন বা রঙিন প্রেস কার্ড হাতে পেলেই অনেকে ‘সাংবাদিক’ পরিচয়ে সুবিধা নেওয়া, চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইলিং ও প্রতারণার মতো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছেন। এতে প্রকৃত সাংবাদিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের সার্বিক বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পাচ্ছে।
একসময় সাংবাদিকতা ছিল সত্য অনুসন্ধানের পেশা—যেখানে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, তথ্যনিষ্ঠতা এবং মানুষের কল্যাণ ছিল মূল লক্ষ্য। কিন্তু বর্তমানে অনেকেই অল্প প্রশিক্ষণ বা কোনো পূর্বজ্ঞান ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে হাতিয়ার করে ‘জেলা প্রতিনিধি’, ‘ক্রাইম রিপোর্টার’ বা ‘ইনভেস্টিগেটিভ সাংবাদিক’ পরিচয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছেন।
নিরীক্ষায় দেখা গেছে, ‘মিডিয়া মালিক’ পরিচয়ে অনেকে অল্প টাকার বিনিময়ে ভুয়া পত্রিকার পরিচয়পত্র ও পদবী বিক্রি করছেন। ঈদ অফারের মতো প্যাকেজে ‘চিফ রিপোর্টার’, ‘বার্তা সম্পাদক’ বা ‘এডিটর’ পদ দেওয়া হচ্ছে। এসব কার্ডধারীর অনেকেই কোনো স্বীকৃত গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত নন; বরং প্রশাসনকে হুমকি, প্রভাব খাটানো বা সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যমের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে দেশে অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল ও আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার কার্ড ব্যবসা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এই অনিবন্ধিত প্ল্যাটফর্মগুলো কোনো আইনি কাঠামো বা নীতিমালা অনুসরণ না করায় সংবাদ পরিবেশনে বিভ্রান্তি ও অপতথ্যের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মূল হুমকিসমূহ: অনিবন্ধিত পোর্টাল কোনো নিয়ম মেনে চলেনা, ফলে যাচাইবাছাই ছাড়াই গুজব ও অপতথ্য ছড়িয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
সাংবাদিকতার নামে ব্ল্যাকমেইলিং ও আর্থিক সুবিধা অর্জন একটি অবৈধ চক্রে পরিণত হয়েছে।
ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে মানহানিকর সংবাদ প্রকাশ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রিপোর্টের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে প্রশাসনের পক্ষে ব্যবস্থা নেওয়াও কঠিন হয়ে উঠছে।
প্রকৃত সাংবাদিকরা বলছেন, সাংবাদিকতার মর্যাদা রক্ষায় জরুরি নীতিমালা, কঠোর যাচাই-বাছাই এবং প্রেস কার্ড প্রদানে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড থাকা প্রয়োজন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার অনুমোদিত সংবাদমাধ্যমগুলোকে কঠোর নীতিমালার আওতায় কাজ করতে হয়, যেখানে তথ্য যাচাই, নিরপেক্ষতা, নৈতিকতা এবং সম্পাদকীয় দায়িত্ব বজায় রাখা বাধ্যতামূলক।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অনিবন্ধিত অনলাইন পোর্টালের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি রোধে ডিজিটাল নিবন্ধন ব্যবস্থা আরও কঠোর করা এবং ভুয়া সাংবাদিকতার নামে কার্ড ব্যবসা বন্ধে আইন প্রয়োগ জরুরি। তাদের বক্তব্য, স্বাধীন সাংবাদিকতা টিকে থাকতে হলে সত্যনিষ্ঠতা, পেশাদারিত্ব এবং নৈতিকতার বিকল্প নেই।
গণমাধ্যমকর্মীরা সতর্ক করে বলছেন—সাংবাদিকতা কখনো কার্ড বা ক্যামেরার পরিচয় নয়; এটি দায়িত্ব, নৈতিকতা এবং সত্যের প্রতি অঙ্গীকারের পরিচয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সত্যিকারের সাংবাদিকরা যে আলোর পথ দেখান, সেই পথচলা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সে নিশ্চয়তা দিতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় তথ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, গণমাধ্যম মালিক এবং পাঠকসমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে। ভুয়া সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণ ও বন্ধ করা, প্রকৃত সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এবং মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা—এটাই এখন সময়ের প্রধান দাবি। দেশের প্রত্যাশা, সাংবাদিকতা যেন আবারও তার প্রকৃত মর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতায় ফিরে আসে।