জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান:
শিশুদের প্রতি সাম্প্রতিক ধারাবাহিক যৌন নিপীড়নের নির্মম ঘটনাগুলো শুধু একটি দেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের বিবেককে ঝাঁকুনি দিয়েছে। নিষ্পাপ শিশুদের আর্তচিৎকার, তাদের ভাঙা নিরাপত্তাবোধ আর পরিবারগুলোর গভীর মানসিক ক্ষত আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। এই আতঙ্কজনক বাস্তবতার মধ্যেই বিশ্বমানবতার অন্যতম শীর্ষ ধর্মীয় ও নৈতিক প্রতিষ্ঠান আল-আজহার প্রকাশ করেছে এক কঠোরতম ও স্পষ্ট বার্তা “শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন মানবজাতির বিরুদ্ধে নিকৃষ্ট পাপ, এই অপরাধের স্থান কোনো সভ্য সমাজে নেই।”
আল-আজহার বলেছে, শিশুদের ওপর যৌন সহিংসতার ঘটনা শুধুমাত্র আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ নয়, এটি মানুষের জন্মগত নৈতিকতা, মমতা ও করুণা সবকিছুর ওপর আঘাত। যে শিশুদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা বড়দের, সেই শিশুদের শরীর, মন ও আত্মসম্মান গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বীভৎস নিষ্ঠুরতায়। এমন ঘটনার পর পরিবারগুলো ভেঙে পড়ে, মায়েরা আতঙ্কে রাতে ঘুমোতে পারেন না, বাবারা হারিয়ে ফেলেন নিজের ওপর ভরসা সমাজের শান্তি অশান্তির অন্ধকারে ডুবে যায়।
এই প্রেক্ষাপটে আল-আজহার যে অবস্থান নিয়েছে, তা বিশ্বের সামনে এক দৃঢ় নৈতিক ঘোষণা,
শিশু নির্যাতনের শাস্তি সর্বোচ্চ কঠোর স্তরে উন্নীত করতে হবে। অপরাধীদের এমন শাস্তি দিতে হবে, যা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অপরাধীর বুকেও ভয় জাগায়। যারা শিশুদের নিষ্পাপত্বকে নোংরা আনন্দ কিংবা গোপন বাণিজ্যের পণ্যে পরিণত করে, তাদের প্রতি কোনো দয়া দেখানো মানবতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
তবে কঠোরতার পাশাপাশি আল-আজহারের বক্তব্যে রয়েছে গভীর কোমলতা। কারণ তারা জানে শিশুর মনই পৃথিবীর সবচেয়ে সহজে ভেঙে যাওয়া কাঁচ। যৌন নিপীড়নের মানসিক ক্ষত অদৃশ্য হলেও দীর্ঘজীবী। তাই প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, আক্রান্ত শিশুদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এবং ধর্মীয় পরামর্শকদের। শিশুটির হৃদয়ে আবার নতুন করে নিরাপত্তা, আস্থা ও নির্ভরতার আলো জ্বালাতে হবে।
অভিভাবকদের প্রতি এসেছে বিশ্বজনীন সতর্কবার্তা সন্তানের প্রতিটি আচরণ লক্ষ করুন, তাদের সঙ্গে কথোপকথনের সেতু অটুট রাখুন, তাদের যেন মনে না হয় যে কোনো ভয় বা লজ্জা তাদের মুখ বন্ধ রাখতে পারে। শিশুরাই যেন প্রথমেই পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করতে পারে।
একই সঙ্গে ডিজিটাল যুগের অন্ধকার দিকেও সতর্ক করেছে আল-আজহার। শিশুদের অনলাইন পরিবেশ এখন শোষণের নতুন ক্ষেত্র তাই শক্তিশালী আইন, কঠোর নজরদারি ও দায়িত্বশীল প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিবৃতির শেষ অংশে আল-আজহার যে বার্তা দিয়েছে, তা যেন গোটা বিশ্বের জন্য এক চেতনার শঙ্খধ্বনি,
শিশুদের সুরক্ষা একটি বৈশ্বিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পরিবার, রাষ্ট্র, শিক্ষক, গণমাধ্যম, নীতিনির্ধারক—সবাইকে একসঙ্গে বহন করতে হবে।
কারণ এ পৃথিবীর ভবিষ্যৎ শিশুদের মুখে লুকিয়ে আছে, আর সেই মুখ থেকে যদি হাসি হারিয়ে যায়,তবে হারায় আমাদের সভ্যতার আলো।
শেষ পর্যন্ত আল-আজহারের ঘোষণাটি একটাই সত্য আবার স্মরণ করিয়ে দিল, শিশুর প্রতি যে হাত ওঠে, সে হাত মানবতার শত্রু, আর যারা সেই শিশুকে রক্ষা করতে দাঁড়ায়, তারাই সভ্যতার আসল বাহক।
লেখক কলামিস্ট ও শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর