আখলাক হুসাইন, সিলেট প্রতিনিধিঃ
জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে সিলেট-৪ আসন। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত ঘেঁষা এই জনপদটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমারোহ। সিলেটের সবচেয়ে বেশি পর্যটন কেন্দ্র এই জনপদে। পাশাপাশি রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিশাল ভান্ডার।
গ্যাস: বাংলাদেশের সর্বপ্রথম গ্যাসক্ষেত্র এই অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়। ১৯৫৫ সালে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুরে প্রথম গ্যাস পাওয়া যায়। যা ১৯৫৭ সাল থেকে উত্তোলন শুরু হয়। এটি সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের (SGFL) অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। এটি দেশের জ্বালানি সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং নতুন কূপ খনন ও উন্নয়নের কাজ চলছে।
কয়লা: সিলেটে সরাসরি বড় কোন কয়লা খনি নেই। তারপরও ভারত থেকে কয়লা আমদানি হয়, যা সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার তামাবিল ও শেওলা স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করে এবং মূলত ইটভাটা, সিমেন্ট ও ইস্পাত কারখানায় ব্যবহৃত হয়। স্থানীয়ভাবে ফুডপান্ডা-র মতো প্ল্যাটফর্মে গ্রিল করার জন্য চারকোল (কয়লা) পাওয়া যায়, যা মূলত কাঠ থেকে তৈরি।
পাথর: সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ, গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং, বিছনাকান্দি সহ বেশ কিছু এলাকায় পাথর উত্তোলন করা হয়। ভোলাগঞ্জের ধলাই নদীর তলদেশে পাওয়া যায় মসৃণ, সাদা ও মজবুত পাথর। এই পাথরগুলো মজবুত নির্মাণ কাজ, রাস্তাঘাট ও সৌন্দর্যবর্ধনে ব্যবহৃত হয়।
বালি: সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন জায়গায়, গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছনাকান্দি, হাদারপার, গোয়াইন নদী, চেঙ্গেরখাল, কাফনা নদী এবং জৈন্তাপুর উপজেলার সারীঘাট সহ বেশ কিছু জায়গায় বালি উত্তোলন করা হয়। সিলেটে মূলত সিলেট স্যান্ড বা লালচে/লাল বালু পাওয়া যায়, যা নির্মাণকাজের জন্য খুবই বিখ্যাত, বিশেষ করে কংক্রীট ঢালাই এবং প্লাস্টারের কাজে ব্যবহৃত হয়। এটি সুরমা নদী এবং এর আশেপাশের এলাকা, যেমন ভোলাগঞ্জ, বিছানাকান্দি থেকে সংগৃহীত হয়, এবং এর দানার আকার বড় হওয়ায় কাঠামোগত শক্তি যোগায়. এছাড়া, বিভিন্ন নদীর উৎস থেকে প্রাপ্ত মসৃণ, সূক্ষ্ম নদী/অস্তর বালি ও পাওয়া যায় যা ফিনিশিংয়ের কাজে লাগে, এবং কিছু বালি প্রক্রিয়াজাত করে গাছের বা অ্যাকুরিয়ামের জন্যও ব্যবহার হয়।
এছাড়াও রয়েছে রাতারগুল, জাফলং, বিছনাকান্দি, সাদাপাথর, জ্বলাটিলা, শাপলাবিল সহ অসংখ্য পর্যটন কেন্দ্র।
বিগত নির্বাচন গুলোর বেশির ভাগ নির্বাচনে এই এলাকা ছিল আওয়ামী লীগের অধীনে।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এ এইচ এম আব্দুল হাই, ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপির ইকবাল হোসেইন চৌধুরী, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইমরান আহমদ, ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে আব্দুল হান্নান, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইমরান আহমদ, ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারী) সালের নির্বাচনে বিএনপির এম সাইফুর রহমান, ১৯৯৬ (জুন) সালের নির্বাচনে বিএনপির এম সাইফুর রহমান, ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইমরান আহমদ, ২০০১ সালের নির্বাচনে দিলদার হোসেন সেলিম, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলোতে ধারাবাহিক ভাবে আওয়ামী লীগের ইমরান আহমদ নির্বাচিত হন।
২০২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির বেশ কয়েকজন প্রার্থীর পদচারণা দেখা গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত গত ৪ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ২য় দফায় বিএনপি এই আসনে একক প্রার্থী ঘোষণা করে সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে। এনিয়ে এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। স্থানীয় বিএনপি এবার নিজেদের এলাকার প্রার্থী আব্দুল হাকিম চৌধুরীকে যে কোন মূল্যে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পাওয়া হয়নি। ওপরদিকে খেলাফত মজলিস, জামাতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে।
এই আসনে খেলাফত মজলিসের একক প্রার্থী সংগঠনের কেন্দ্রীয় উলামা বিষয়ক সম্পাদক বরেণ্য আলেম ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় শায়খ মুফতি আলী হাসান ওসামা, জামাতে ইসলামীর একক প্রার্থী সংগঠনের সিলেট জেলা শাখার সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একক প্রার্থী সংগঠনের আইন বিষয়ক সম্পাদক এড. মুহাম্মদ আলী, ইসলামি আন্দোলনের একক প্রার্থী মাওলানা সাঈদ আহমদ এবং এনসিপির একক প্রার্থী রাশেদ উল আলম।
জমিয়ত যেহেতু বিএনপির সাথে জোট করে নির্বাচনে যাচ্ছে তাই শেষ পর্যন্ত এই আসনে তাদের প্রার্থী থাকছেন না এটা প্রায় নিশ্চিত।
এনসিপি যদি তৃতীয় কোন জোট করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাহলে শেষ পর্যন্ত এনসিপির রাশেদ উল আলম বা অন্য কোন দলের প্রার্থী নির্বাচন করতে পারেন। তবে এই জোট বা একক প্রার্থী সিলেট-৪ আসনে সাংগঠনিক অবস্থা তেমন শক্ত না থাকায় ভোটের মাঠে প্রভাব পড়বে বলে ভোটাররা মনে করছেন না।
বাকি থাকে ইসলামি ও সমমনা ৮ দলীয় জোট। এই জোট থেকে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছেন খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় উলামা বিষয়ক সম্পাদক মুফতি আলী হাসান ওসামা এবং জামাতে ইসলামীর সিলেট জেলা শাখার সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন। আলেম উলামা অধ্যুষিত এই অঞ্চলে অতীত থেকে জামাতের সমালোচনা সারা দেশের তোলনায় এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। তাই অনেকে মনে করছেন এই আসনে জামাতের প্রার্থী জয়নাল আবেদীন নির্বাচন করলে এই অঞ্চলের জামাত বিরোধী সমালোচনা সারা দেশে প্রভাব ফেলতে পারে। অপরদিকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থী না থাকলে জমিয়তের ভোট বিএনপিতে যাচ্ছে না। এই ক্ষেত্রে জামাতের প্রার্থী থাকলে জমিয়তের ভোট বিএনপিতে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিএনপির দলীয় কোন্দলের কারণে এবং স্থানীয় বিএনপির নেতৃত্বের দাবির প্রতি কেন্দ্রীয় বিএনপি ভ্রুক্ষেপ না করায় তারা এখনও ক্ষুব্ধ। তাই আরিফুল হক চৌধুরী এই আসন থেকে জয়লাভ করলে স্থানীয় নেতৃত্ব তোলা আর সম্ভব হবে না বলে বিএনপির অনেকে মনে করছেন। এজন্য বিএনপির স্থানীয় একাধিক প্রার্থী স্বতন্ত্র নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সব মিলিয়ে বিএনপির কোন গ্রুপ অন্য কোন গ্রুপকে ছাড় দিতে নারাজ। আবার এখানে জামাত যেন ঘাঁটি গাড়তে না পারে সে দিকেও সজাগ বিএনপির স্থানীয় নেতৃত্ব। অনেকে মনে করছেন খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মুফতি আলী হাসান ওসামা এখানে ইসলামি ও সমমনা ৮দল থেকে নির্বাচন করলে কেমন যেন বিএনপির স্থানীয় নেতৃত্ব পরবর্তীতে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
এখন দেখার বিষয় ইসলামি ও সমমনা ৮ দলীয় জোট এই আসনে কাকে মনোনয়ন দেয়। আরিফুল হক চৌধুরীর প্রতিযোগী কে হচ্ছেন এটাই এখন দেখার বিষয়