স্বাধীনতার মাস—যে মাসে রাষ্ট্র তার গৌরব, পতাকা ও অর্জনের গল্প শোনায়—সেই মাসেই শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যা করা হলো। এই হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার এক নির্মম দলিল। লাল-সবুজের আনুষ্ঠানিক উৎসবের আড়ালে আবারও প্রমাণ হলো—বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও তার জনগণ নিরাপদ নয়।
শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন জুলাইয়ের আন্দোলনের একজন সাহসী যোদ্ধা। স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা ছিল স্পষ্ট ও সক্রিয়। তাঁর কণ্ঠ ছিল সত্যের পক্ষে, তাঁর কলম ছিল নীতির পক্ষে। তিনি ছিলেন না ক্ষমতার সেবক, তিনি ছিলেন বিবেকের প্রতিনিধি। আর ঠিক এই কারণেই তিনি ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন—যে ঝুঁকি রাষ্ট্র বুঝতেও পারেনি, কিংবা বুঝেও উপেক্ষা করেছে।
মৃত্যুর পর রাষ্ট্রের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। লাশ দেশে আনার জন্য বাহিনী, নিরাপত্তা, প্রটোকল—সবই হাজির। কিন্তু এই দৃশ্য এক গভীর প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, জীবিত থাকতে এই নিরাপত্তা কোথায় ছিল? যদি এই সুরক্ষা আগে দেওয়া হতো, তবে কি আজ একজন তরুণ কণ্ঠকে লাশ হয়ে ফিরতে হতো? মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় আয়োজন কখনোই জীবনের নিরাপত্তাহীনতার দায় ঢাকতে পারে না।
আজকের বাংলাদেশ নামেমাত্র স্বাধীন। সাধারণ মানুষের কোনো প্রকৃত নিরাপত্তা নেই। অপরাধীরা নির্বিঘ্নে দেশ ছাড়ে, আর রাষ্ট্র জানে না—অথবা জানার দায় নেয় না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও আইন মন্ত্রণালয় ব্যর্থতার দায় এড়াতে নীরব থাকে। এখানে বিচার বিলম্বিত নয়, বিচার অনুপস্থিত।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এই রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। শাসনের মুখ বদলেছে, কিন্তু দালালির কাঠামো টিকে আছে। সুবিধাবাদী চক্র বারবার ক্ষমতার পাশে দাঁড়িয়েছে, আর সত্য বলার কণ্ঠগুলো একে একে নিস্তব্ধ হয়েছে—কখনো ভয়ে, কখনো হত্যায়।
শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যু তাই শুধু একজন ব্যক্তির মৃত্যু নয়, এটি একটি ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতীক। রাষ্ট্র যখন সমালোচনার কণ্ঠকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তখন সে নিজেই হত্যার নীরব অংশীদার হয়ে ওঠে। এই দায় কোনো ব্যক্তির নয়—এটি রাষ্ট্রীয় দায়, নৈতিক দায়।
এই লেখা কোনো প্রতিহিংসার আহ্বান নয়, এটি জবাবদিহির দাবি। স্বাধীনতার মাসে আমাদের প্রশ্ন একটাই—রাষ্ট্র কি কেবল দিবস পালনের যন্ত্র, নাকি নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্বও তার আছে? যতদিন এই প্রশ্নের সৎ উত্তর না মিলবে, ততদিন স্বাধীনতা থাকবে স্লোগানে, জনগণ থাকবে অনিরাপদ বাস্তবতায়।
জাহিদুল ইসলাম, লেখক কলামিস্ট ও শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর