২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৩রা রজব, ১৪৪৭ হিজরি

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীসেবার আমূল পরিবর্তন, আলোচনার কেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে এম আবু নওশাদ

নিজস্ব প্রতিনিধি:

কিছুদিন আগেও ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রী ভোগান্তি ছিল নিত্যদিনের চিত্র—প্রবাসী যাত্রী হয়রানি, অব্যবস্থাপনা, লাগেজ চুরি, অতিরিক্ত মূল্য আদায়, দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য এবং সেবার নামে অনিয়ম নিয়ে অভিযোগের শেষ ছিল না।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই চিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে বলে জানাচ্ছেন দেশি-বিদেশি যাত্রীরা। আগের তুলনায় এখন বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, লাগেজ থেকে মালামাল চুরির ঘটনা কমেছে, হেল্প ডেস্কের কার্যক্রম বেড়েছে এবং অনিয়ম দেখলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে—এই পরিবর্তনের নেপথ্যে মূল ভূমিকা রেখেছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে এম আবু নওশাদ—এমনটাই দাবি করছেন প্রবাসী যাত্রীরা।

দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নির্ধারিত ডিউটি সময়ে পুরো বিমানবন্দর চষে বেড়ানো, কোথাও কোনো অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনা চোখে পড়লেই তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তিনি যাত্রীসেবায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন।

এদিকে যাত্রীসেবা বাড়াতে তার নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের ভিডিও ও ছবি তিনি নিজেই নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ করছেন, যা প্রতিদিন মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ পাচ্ছে এবং দেশ-বিদেশের প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। যাত্রীরা তার এই তৎপরতাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন এবং ভবিষ্যতেও এমন কঠোর ও দৃশ্যমান অ্যাকশন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।

তবে কে এম আবু নওশাদ নিজেই বলছেন, শাহজালাল বিমানবন্দরে তিনি একা নন; তার সঙ্গে আরও সাতজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করছেন এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)সহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সমন্বিতভাবে যাত্রীসেবা নিশ্চিতে কাজ করছেন, শুধু ফেসবুকে তার অভিযানগুলোর প্রচার বেশি হওয়ায় অনেকের কাছে মনে হচ্ছে সব কাজ তিনি একাই করছেন।

গত নভেম্বরের শুরুতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদানের পর থেকেই একের পর এক উদ্যোগ নিয়ে আলোচনায় আসেন নওশাদ; ৫ নভেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে পণ্যের গায়ে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করায় এক দোকানদারকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন, একই দিনে মাদকসেবন করে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বিমানবন্দর এলাকায় বিশৃঙ্খলা করার অপরাধে একজনকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেন, পকেট কাটার সময় একজনকে হাতেনাতে আটক করে এক মাসের কারাদণ্ড দেন এবং পাবলিক প্লেসে ধূমপান প্রতিরোধে জরিমানাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেন।

৮ নভেম্বর ভিড়ের মধ্যে বিশৃঙ্খলা করায় এক ইভটিজারকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়; ২০ নভেম্বর বিমানবন্দরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সচেতনতামূলক ব্যানার স্থাপন করা হয়।

২৫ নভেম্বর লাগেজ চুরির অপরাধে একজনকে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে চুরি হওয়া লাগেজ উদ্ধার করা হয়। ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যার পর এয়ারপোর্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসিয়াল নম্বরে ফোন পেয়ে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে আনসার ও এপিবিএন সদস্যসহ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ৩০ টাকার জুস ৩৫ টাকায় বিক্রির অভিযোগে অভিযুক্ত দোকানিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ অনুযায়ী ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

৩ ডিসেম্বর হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীদের চলাচলের পথে থাকা বাধা অপসারণ করে তালা খুলে দেওয়া হয় এবং ঘোষণা দেওয়া হয় যে বিদেশ থেকে আগত হুইলচেয়ার যাত্রীরা প্রয়োজনে হুইলচেয়ারসহ ক্যানোপি-২ বা এক্সিট গেট-২ দিয়ে সরাসরি অপেক্ষমাণ গাড়ি পর্যন্ত যেতে পারবেন। ৮ ডিসেম্বর মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনায় একজনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে মোবাইল উদ্ধার করা হয়।

১০ ডিসেম্বর পচা সমুচা বিক্রির অপরাধে একটি দোকানকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ১১ ডিসেম্বর শৌচাগারে টিস্যুর বিনিময়ে টাকা আদায় ও অ্যারাইভাল ফরম পূরণ করে বকশিশ দাবি করার অভিযোগ ফেসবুকে নজরে আসার পর রাতেই সব শৌচাগার পরিদর্শন করে ঘোষণা দেওয়া হয়—এখন থেকে বিমানবন্দরে দায়িত্বরত একজন ক্লিনারের কাছে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা রাখা যাবে।

একই দিনে প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্ধারিত দুটি শৌচাগার ও একটি পুরুষ শৌচাগারে টিস্যু না থাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির ডিউটি বাতিল এবং ৯৩টি শৌচাগারের মধ্যে তিনটিতে টিস্যু না রাখার দায়ে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

১৫ ডিসেম্বর লাগেজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি জানান, লাগেজ কাটা বা চুরি শতভাগ প্রতিরোধে বাংলাদেশ বিমান ইতোমধ্যে বডি ওর্ন ক্যামেরা ব্যবহার শুরু করেছে, যাতে নিজস্ব ফ্লাইটগুলোর লাগেজ ব্যবস্থাপনা আরও নিশ্ছিদ্র হয় এবং দায়ী ব্যক্তিকে সহজেই শনাক্ত করা যায়।

এসব অভিযান ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ভিডিও নিয়মিত ফেসবুকে প্রচার হওয়ায় প্রবাসী যাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে; অনেকেই তাকে ‘ফাটাকেস্ট ম্যাজিস্ট্রেট’ বলে আখ্যা দেন এবং মন্তব্যে প্রশংসা জানান—যেমন মোহাম্মদ মহসিন ভূঁইয়া লেখেন, ‘প্রবাসীরা যুগ যুগ ধরে আপনার দায়িত্ব স্মরণ রাখবে’, আর সজীব আলী মন্তব্য করেন, ‘ধন্যবাদ ভাই, আপনি কাজ চালিয়ে যান, অল্প সময়ে অনেক প্রবাসীর মনে জায়গা করে নিয়েছেন’। তবে লাগেজ ওঠানামার কাজে বডি ক্যামেরা ব্যবহারের ভিডিও ভাইরাল হলে কৃতিত্ব এককভাবে নওশাদকে দেওয়া নিয়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমানের পক্ষ থেকে সমালোচনাও ওঠে।

এ প্রেক্ষিতে ১৯ নভেম্বর নিজের ফেসবুক পেজে তিনি স্পষ্ট করেন যে বডি ক্যামেরা চালুর পেছনে রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের বহু মাসের পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত এবং বেবিচক ও বাংলাদেশ বিমানের বাস্তবায়ন রয়েছে।

কোনো একক কৃতিত্বের দাবি তিনি করেননি এবং সমন্বয়হীন প্রচার ভালো উদ্যোগের পথ হারাতে পারে। সবশেষে কে এম আবু নওশাদ জানান, তিনি বিমানবন্দরে যোগদানের পর থেকে রুটিন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছেন, অন্যান্য ম্যাজিস্ট্রেটও একইভাবে কাজ করছেন, আর তার অভিযানগুলোর প্রচার যাত্রীদের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করছে—যতদিন তিনি বিমানবন্দরে থাকবেন, ততদিন যাত্রীসেবাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই দায়িত্ব পালন করে যাবেন।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top