নিজস্ব প্রতিনিধি:
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির একনেক সভায় মোট ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয় সম্বলিত ২২টি উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যা চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের সপ্তম এবং অন্তর্বর্তী সরকারের অষ্টাদশ একনেক সভা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত পরিকল্পনা কমিশন চত্বরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এই গুরুত্বপূর্ণ সভায় সভাপতিত্ব করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও একনেকের চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সভা শেষে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অনুমোদিত ২২টি প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ৪৮২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, প্রকল্প ঋণ হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে ১ হাজার ৬৮৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অর্থায়ন রয়েছে ১৪ হাজার ২৪৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, জ্বালানি, শিল্প ও সামাজিক খাতে দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। একনেক সভায় অনুমোদিত প্রকল্পগুলো জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এগুলোর মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন সহায়তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন, নগর ও গ্রামীণ উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা শক্তিশালীকরণ সংক্রান্ত প্রকল্প।
সভায় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিবরা, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যবৃন্দ এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। একনেক সভায় আলোচনাকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সময়ানুবর্তিতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন এবং বলেন, জনগণের করের অর্থ যেন যথাযথভাবে ব্যয় হয় এবং প্রকল্প গ্রহণের মূল লক্ষ্য যেন বাস্তবে প্রতিফলিত হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়নে বাস্তবসম্মত ও প্রয়োজনভিত্তিক প্রকল্প অনুমোদনের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। সভায় জানানো হয়, অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নকাল নির্ধারণ করা হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদে এবং এগুলোর অধিকাংশই মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং দেশীয় শিল্প ও সেবাখাতে গতিশীলতা আনবে।
পাশাপাশি বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে শর্ত ও সুদের হার পর্যালোচনা করে ঝুঁকি কমানোর দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একনেক সভায় আরও বলা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, সময়ক্ষেপণ ও নকশা পরিবর্তনের প্রবণতা কমাতে কঠোর নজরদারি থাকবে।
সভায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়মিতভাবে মনিটরিং করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, চলতি অর্থবছরে সরকারের উন্নয়ন ব্যয় বাড়ানোর অংশ হিসেবেই এই ২২টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং এগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে গতি আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বড় অঙ্কের এই বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সচল রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তারা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা ও দক্ষ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলে এই প্রকল্পগুলো দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক সেবার মানোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
একনেক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত শুরু করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও আর্থিক প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা হবে এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়মিতভাবে একনেক ও উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের কাছে উপস্থাপন করা হবে, যাতে যেকোনো সমস্যা দ্রুত চিহ্নিত করে সমাধান করা যায়। সামগ্রিকভাবে, ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের এই ২২টি প্রকল্প অনুমোদনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, টেকসই উন্নয়ন এবং জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে একটি শক্ত অবস্থান নেওয়ার বার্তা দিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।