নিজস্ব প্রতিনিধি:
নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় চর দখলকে কেন্দ্র করে জলদস্যুদের তিনটি গ্রুপের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার ২৩ ডিসেম্বর দুপুর আনুমানিক ২টার দিকে হাতিয়া উপজেলার জাগলার চরে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। স্থানীয় সূত্র ও পুলিশ জানিয়েছে, সংঘর্ষে কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। তবে দুর্গম চরাঞ্চল হওয়ায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরেই হাতিয়ার জাগলার চরকে কেন্দ্র করে একাধিক জলদস্যু গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। মঙ্গলবার দুপুরে সেই বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। আধিপত্য বিস্তার ও চরের নিয়ন্ত্রণ নিতে জলদস্যুদের তিনটি সশস্ত্র গ্রুপ মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ব্যাপক গোলাগুলি ও দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়, যা কয়েক ঘণ্টা ধরে চলতে থাকে। এতে ঘটনাস্থলেই অন্তত পাঁচজন নিহত হন এবং আরও অনেকে গুরুতর আহত হন বলে স্থানীয়দের দাবি।
হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল আলম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, জাগলার চরে জলদস্যুদের মধ্যে সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে এখনো নিহতদের নাম-পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। দুর্গম চরাঞ্চল এবং প্রতিকূল পরিবেশের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেননি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে বলে তিনি জানান।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সংঘর্ষে জড়িত জলদস্যু গ্রুপগুলো দীর্ঘদিন ধরে হাতিয়ার বিভিন্ন চরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও জোরপূর্বক চর দখলের সঙ্গে যুক্ত। জাগলার চরটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এখানে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। মঙ্গলবারের সংঘর্ষে সামসু গ্রুপ, আলা উদ্দিন গ্রুপ এবং ফরিদ গ্রুপ সরাসরি অংশ নেয় বলে জানা গেছে।
সংঘর্ষের পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গোলাগুলির শব্দে পুরো চর এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দিগ্বিদিক ছুটে পালাতে থাকে। অনেক জেলে ও চরবাসী নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে আশপাশের চরে বা নদীপথে নিরাপদ স্থানে সরে যান। সংঘর্ষ চলাকালে কেউ কাছে যাওয়ার সাহস পায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা যায়, সংঘর্ষ শেষে জলদস্যুদের তিন গ্রুপের শীর্ষ নেতারা নিজেদের লোকজন নিয়ে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করেন। সামসু গ্রুপের প্রধান শামুস, আলা উদ্দিন গ্রুপের প্রধান আলাউদ্দিন এবং ফরিদ গ্রুপের প্রধান ফরিদ কমান্ডার সংঘর্ষের পর লোকজনসহ লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি এলাকার দিকে পালিয়ে যান। ধারণা করা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের আশঙ্কায় তারা ওই দিকে সরে গেছে।
স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা সূত্র জানায়, হাতিয়া ও আশপাশের চরাঞ্চলে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য নতুন নয়। একাধিক গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে নদী ও চরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বিশেষ করে নতুন জেগে ওঠা চরগুলো দখল করে সেখানে অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করাই এসব গ্রুপের মূল লক্ষ্য। এর আগেও হাতিয়ায় চর দখলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, খুন ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।
হাতিয়ার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, এই সংঘর্ষে নিরীহ চরবাসী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা বলেন, জলদস্যুদের দাপটে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। চরে বসবাসকারী জেলে ও কৃষকেরা নিয়মিত চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। মঙ্গলবারের এই সংঘর্ষ তারই ভয়াবহ বহিঃপ্রকাশ।
এদিকে, সংঘর্ষের খবর পাওয়ার পর নোয়াখালী জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যৌথ বাহিনীর অভিযান জোরদার করা হবে। প্রয়োজনে নৌপথে অভিযান চালিয়ে জলদস্যুদের অবস্থান চিহ্নিত করা হবে। তবে দুর্গম চরাঞ্চল হওয়ায় অভিযান পরিচালনায় কিছুটা সময় লাগতে পারে বলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হাতিয়া ও আশপাশের চরাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে জলদস্যু সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হওয়ায় এ ধরনের সহিংসতা বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তারা বলছেন, শুধু অভিযানের মাধ্যমে নয়, প্রশাসনিক নজরদারি, স্থানীয় জনসম্পৃক্ততা এবং টেকসই আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা গড়ে তুললেই এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
এই সংঘর্ষের ঘটনায় এলাকায় এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষ আতঙ্কে রয়েছে এবং নতুন করে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে স্থানীয়দের শঙ্কা।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মরদেহ এখনো ঘটনাস্থলেই রয়েছে বলে জানা গেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিহতদের পরিচয় শনাক্ত এবং মরদেহ উদ্ধারের কাজ শুরু করবে পুলিশ। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের হয়নি। তবে প্রশাসন জানিয়েছে, সংঘর্ষে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।
হাতিয়ায় চর দখলকে কেন্দ্র করে জলদস্যুদের এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আবারও প্রমাণ করল, উপকূলীয় ও চরাঞ্চলে সন্ত্রাস দমনে সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।