২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৩রা রজব, ১৪৪৭ হিজরি

তুরস্কের কোনিয়া প্রদেশে ভয়াবহ সিঙ্কহোল সংকট, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ধসে পড়ায় বাড়ছে জীবন ও কৃষি ঝুঁকি

নিজস্ব প্রতিনিধি:

তুরস্কের মধ্যাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৃষিভিত্তিক অঞ্চল কোনিয়া প্রদেশে ভয়াবহ পরিবেশগত সংকট হিসেবে দ্রুতগতিতে বাড়ছে সিঙ্কহোল বা ভূগর্ভস্থ ধসের ঘটনা, যা দেশটির খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উৎপাদন এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠছে।

বিশেষ করে কোনিয়ার কারাপিনার অঞ্চল এখন কার্যত সিঙ্কহোলের হটস্পটে পরিণত হয়েছে, যেখানে বিস্তীর্ণ ভুট্টা ও গমের খেতে হঠাৎ করেই তৈরি হচ্ছে বিশাল আকৃতির গর্ত।

কোথাও কোথাও একটি মাত্র কৃষিজমিতেই একসঙ্গে ১০টির বেশি সিঙ্কহোল সৃষ্টি হয়েছে, যা কৃষকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক তৈরি করেছে। স্থানীয় কৃষক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘদিনের কম বৃষ্টিপাত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণহীন ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণেই এই বিপর্যয় দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করছে।

আগে যে অঞ্চল ছিল তুরস্কের শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত, সেখানে এখন প্রতিনিয়ত ভূমি ধসের আশঙ্কায় চাষাবাদ চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত বহু প্রাচীন পানিভরা প্রাকৃতিক গর্ত বা কার্স্ট লেক ইতোমধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে, যা প্রমাণ করছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কতটা ভয়াবহভাবে নেমে গেছে।

কোনিয়া টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ফেতুল্লাহ আরিক জানিয়েছেন, কোনিয়া অববাহিকায় এ পর্যন্ত প্রায় ৭০০টির মতো সিঙ্কহোল শনাক্ত করা হয়েছে, যা গত কয়েক দশকের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। তার ভাষায়, এক সময় বছরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যেখানে গড়ে আধা মিটার কমত, সেখানে এখন তা বছরে ৪ থেকে ৫ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে, যা ভূগর্ভস্থ শিলাস্তরকে দুর্বল করে দিচ্ছে এবং হঠাৎ ধসের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তুলছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরণ বদলে যাওয়ায় কোনিয়া অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে পানির পুনর্ভরণ প্রায় বন্ধের পথে, অথচ কৃষি নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা বাধ্য হয়ে গভীর নলকূপ খননের দিকে ঝুঁকছেন।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এই অঞ্চলে বৈধ কূপের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার হলেও বাস্তবে অবৈধ কূপের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারে, যা পরিস্থিতিকে আরও নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলছে।

এসব অবৈধ কূপ থেকে লাগামহীন পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ ফাঁপা স্তরগুলো ধসে পড়ছে এবং বিশালাকার সিঙ্কহোল তৈরি হচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত এসব সিঙ্কহোলে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি, তবুও হঠাৎ ভূমি ধস মানুষের জীবন, বসতবাড়ি, কৃষি যন্ত্রপাতি এবং ফসলের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। অনেক ক্ষেত্রেই সিঙ্কহোলগুলো রাতারাতি তৈরি হচ্ছে, কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই, যা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। কারাপিনার এলাকার কৃষক মুস্তাফা শিক জানান, গত দুই বছরে তার নিজ জমিতেই দুটি বড় সিঙ্কহোল তৈরি হয়েছে।

২০২৪ সালের আগস্ট মাসে দ্বিতীয় গর্তটি তৈরি হওয়ার সময় তার ভাই মাত্র কয়েক মিটার দূরে মাঠে কাজ করছিলেন এবং হঠাৎ বিকট শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। তার ভাষায়, শব্দটি এতটাই ভয়ংকর ছিল যে মনে হয়েছিল ভূমিকম্প হয়েছে, অথচ চোখের সামনে দেখা গেল জমি ফেটে বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে। ভূতত্ত্ববিদদের সাম্প্রতিক জরিপে মুস্তাফা শিকের জমিতে আরও দুটি স্থানকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তবে সেগুলো ঠিক কখন ধসে পড়বে, সে বিষয়ে কেউই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না।

এই অনিশ্চয়তা কৃষকদের মানসিক চাপ আরও বাড়িয়ে তুলছে, কারণ তারা জানেন না পরবর্তী ধসটি কখন, কোথায় ঘটবে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, যদি এখনই অবৈধ কূপ নিয়ন্ত্রণ, টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু অভিযোজনমূলক কৃষি নীতি বাস্তবায়ন না করা হয়, তাহলে কোনিয়া অঞ্চলের একটি বড় অংশ ভবিষ্যতে বসবাস ও চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।

তুরস্কের খাদ্য উৎপাদনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এই অঞ্চল থেকে আসে, ফলে সিঙ্কহোল সংকট কেবল একটি স্থানীয় সমস্যা নয়, বরং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি।

পরিবেশবিদরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প সেচব্যবস্থা, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং কম পানিনির্ভর ফসল চাষের দিকে যেতে না পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।

একই সঙ্গে কঠোরভাবে অবৈধ কূপ বন্ধ করা এবং কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। অন্যথায়, কোনিয়ার বিস্তীর্ণ কৃষিজমি একের পর এক সিঙ্কহোলে গ্রাস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে, যা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, মানুষের জীবনকেও স্থায়ী ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top