নিজস্ব প্রতিনিধি:
ফেনী জেলা নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক কোষাধ্যক্ষ ওবায়দুল হক ফেনী-২ আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করায় জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আলোচনা, সমালোচনা ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।
মঙ্গলবার ২৩ ডিসেম্বর ফেনী জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে তিনি আমজনতার দলের ব্যানারে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরপরই জুলাই যোদ্ধা, ছাত্র আন্দোলনের কর্মী, নতুন রাজনৈতিক ধারার সমর্থক এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
অনেকেই এটিকে নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত থাকা আওয়ামী লীগের নেতাদের নতুন নামে রাজনীতিতে পুনঃপ্রবেশের কৌশল হিসেবে দেখছেন। জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার পর্যন্ত ফেনী জেলার তিনটি সংসদীয় আসনে মোট ৩০ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
এর মধ্যে ফেনী-১ আসনে সাতজন, ফেনী-২ আসনে ১১ জন এবং ফেনী-৩ আসনে ১২ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। ফেনী-১ আসনে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির আরও তিনজন নেতা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। একইভাবে ফেনী-২ আসনে বিএনপির দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি আরও দুইজন এবং ফেনী-৩ আসনে দলীয় প্রার্থীর বাইরে বিএনপির আরও দুজন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
এই প্রেক্ষাপটে ফেনী-২ আসনে ওবায়দুল হকের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ নতুন করে বিতর্ক উসকে দিয়েছে। স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ফেনী দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।
জুলাই আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত এবং দলীয় কার্যক্রম নিষ্ক্রিয় হওয়ার পরও স্থানীয় পর্যায়ে দলটির অনেক নেতা-কর্মী বিভিন্ন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম বা নতুন দল ব্যবহার করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
ওবায়দুল হকের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে, কারণ তিনি সরাসরি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং সাবেক কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
মনোনয়নপত্র সংগ্রহের বিষয়ে ওবায়দুল হক নিজেই গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হলেও দলটির নিবন্ধন স্থগিত থাকায় তিনি বিকল্প রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আমজনতার দল থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
তার বক্তব্যে তিনি এটিকে একটি বাস্তবতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তবে তার এই ব্যাখ্যা জেলার অনেক রাজনৈতিক কর্মী ও আন্দোলনকারীদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আমজনতার দল ফেনী জেলা শাখার আহ্বায়ক আশিষ দত্ত প্রকাশ্যে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ফেনী-২ আসনে আমজনতার দলের প্রার্থী হিসেবে ওবায়দুল হক মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন এবং দলীয়ভাবে বিষয়টি জানেন তারা।
এই বক্তব্যের পর আমজনতার দলকেও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, একটি নতুন বা বিকল্প রাজনৈতিক দল কীভাবে অতীতে ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতাকে মনোনয়ন দেয় এবং এতে তাদের ঘোষিত রাজনৈতিক অবস্থান কতটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। জুলাই আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা যুবায়ের আল মুজাহিদ এ প্রসঙ্গে কড়া ভাষায় বলেন, আওয়ামী লীগ বিভিন্ন নামে ও ব্যানারে রাজনীতিতে ঢুকে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।
তার ভাষায়, আওয়ামী লীগ যে নামেই আসুক, যে দলের ব্যানারেই আসুক, তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করা হবে। এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক জুলাই যোদ্ধা ও ছাত্র আন্দোলনের কর্মী এতে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তারা মনে করছেন, জুলাই আন্দোলনের মূল চেতনা ছিল পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির অবসান ঘটানো।
সেখানে একই ব্যক্তিরা নতুন নামে আবার নির্বাচনে আসা আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। ফেনীর বিভিন্ন এলাকায় এ নিয়ে চায়ের দোকান, বাজার ও সামাজিক আড্ডায় আলোচনা চলছে।
কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের উচিত মনোনয়ন যাচাইয়ের সময় রাজনৈতিক পরিচয় ও অতীত ভূমিকা কঠোরভাবে বিবেচনায় নেওয়া। আবার অনেকে মনে করছেন, আইন অনুযায়ী নিবন্ধিত কোনো দলের মনোনয়ন পেলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সাংবিধানিক অধিকার, সেখানে রাজনৈতিক বা নৈতিক প্রশ্ন আলাদা বিষয়।
তবে জুলাই আন্দোলনের পর যে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তাতে জনগণের একটি বড় অংশ পুরোনো ক্ষমতাকাঠামোর প্রতিনিধিদের আর গ্রহণ করতে রাজি নয়। ফেনী-২ আসনটি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য দলগুলোর শক্ত অবস্থান রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই আসনে রাজনৈতিক সহিংসতা, দখলবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে। ফলে এবারের নির্বাচনকে অনেকেই পরীক্ষার মঞ্চ হিসেবে দেখছেন, যেখানে বোঝা যাবে জনগণ আসলেই নতুন রাজনৈতিক ধারা চায় নাকি পুরোনো মুখই আবার ফিরে আসবে।
ওবায়দুল হকের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ সেই পরীক্ষাকে আরও জটিল করে তুলেছে। একদিকে তিনি অভিজ্ঞ রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত, অন্যদিকে তার অতীত রাজনৈতিক পরিচয় বিতর্কের কেন্দ্রে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা শুধু ফেনী নয়, সারা দেশের রাজনীতির একটি প্রবণতার প্রতিফলন।
নিবন্ধন স্থগিত বা নিষিদ্ধ দলগুলোর নেতারা নতুন বা ছোট দল ব্যবহার করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করছেন, যা ভবিষ্যতে বড় রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, মনোনয়ন যাচাই প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নৈতিক অবস্থান—সবকিছু মিলিয়ে এই ইস্যু জাতীয় পর্যায়েও আলোচনার জন্ম দিতে পারে।
ফেনীর সাধারণ ভোটারদের একটি অংশ বলছেন, তারা মুখ নয়, কাজ ও অবস্থান দেখে ভোট দেবেন। আবার অনেক তরুণ ও জুলাই আন্দোলনের সমর্থক স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন, পুরোনো ক্ষমতাকাঠামোর প্রতিনিধিদের তারা আর সংসদে দেখতে চান না।
সব মিলিয়ে ফেনী-২ আসনে ওবায়দুল হকের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ শুধু একটি নির্বাচনি ঘটনা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক রূপান্তর, দ্বন্দ্ব ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার প্রতীক হয়ে উঠেছে।