নিজস্ব প্রতিনিধি:
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও জুলাই বিপ্লবের অন্যতম সংগঠক শহীদ শরীফ ওসমান হাদিকে হত্যার প্রতিবাদে বিশ্বের সাতটি দেশের ভারতীয় দূতাবাসের সামনে একযোগে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে পাঞ্জাবের স্বাধীনতাকামী শিখ সম্প্রদায়ের একটি অংশ। আজ বুধবার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায় এই কর্মসূচি পালিত হবে বলে জানানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা শিখস ফর জাস্টিসের জেনারেল কাউন্সেল গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুন এক ভিডিও বার্তায় এই ঘোষণা দেন। ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, বাংলাদেশে সংঘটিত সাম্প্রতিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শুধু একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
তার ভাষায়, শহীদ শরীফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড একটি সুপরিকল্পিত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ, যার সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে তারা মনে করেন।
পান্নুন জানান, এই অভিযোগ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতেই বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শহরে ভারতীয় দূতাবাস ও কনস্যুলেটের সামনে একযোগে বিক্ষোভ কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ঢাকা, পাকিস্তানের ইসলামাবাদ, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ইতালির মিলান, কানাডার টরন্টো ও ভ্যাঙ্কুভার এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি শহরে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোর সামনে শিখ সম্প্রদায়ের সদস্য ও সমর্থকেরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করবেন।
এই কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে কথিত গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা এবং মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরা।
পান্নুনের বক্তব্য অনুযায়ী, বুধবার নিজ নিজ অঞ্চলের স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায় শিখ সম্প্রদায়ের কর্মীরা ভারতীয় কনস্যুলেটগুলো বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন, যাতে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় এবং ভারত সরকারের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ স্পষ্টভাবে তুলে ধরা সম্ভব হয়।
তিনি আরও বলেন, শিখস ফর জাস্টিস দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বাইরে সংঘটিত কথিত গুপ্তহত্যা, নজরদারি এবং বিরোধী কণ্ঠ দমনের অভিযোগ নিয়ে কাজ করে আসছে এবং বাংলাদেশে ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড সেই ধারাবাহিকতারই অংশ বলে তারা মনে করেন।
ভিডিও বার্তায় পান্নুন দাবি করেন, ভারত ইতোমধ্যেই ওসমান হাদিকে হত্যা করেছে এবং এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনগুলো থেকেই পরিচালিত হয়েছে।
তার ভাষায়, ভারতীয় দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলো কেবল কূটনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্র নয়, বরং এগুলোকে তারা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর অপারেশনাল হাব হিসেবে বিবেচনা করেন।
এখান থেকেই নাকি বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক বিরোধী, মানবাধিকার কর্মী ও আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নজরদারি, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয় বলে তিনি অভিযোগ করেন।
পান্নুন আরও একধাপ এগিয়ে দাবি করেন, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি দায়ী এবং তার নির্দেশেই ওসমান হাদিকে হত্যা করা হয়েছে। তার মতে, বাংলাদেশে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে নয়, বরং এটি ছিল জুলাই বিপ্লবের চেতনা, ছাত্র আন্দোলন এবং ভারতের আধিপত্যবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানকে দমন করার একটি কৌশল।
এই কারণেই শিখ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে শুধু বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তান, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে একযোগে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ঢাকায়, ইসলামাবাদে, মেলবোর্নে, লন্ডনে, মিলানে, টরন্টো ও ভ্যাঙ্কুভারে এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে একযোগে কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।
এই কর্মসূচির মাধ্যমে তারা জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের কথিত হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তের আহ্বান জানাবেন।
শিখস ফর জাস্টিসের এই ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া একটি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে যদি একাধিক দেশে কূটনৈতিক মিশনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়, তাহলে বিষয়টি কেবল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক ও মানবাধিকার আলোচনার অংশ হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে, সমালোচকেরা বলছেন, এই ধরনের অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর এবং এর পক্ষে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ প্রয়োজন। তবে শিখস ফর জাস্টিসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা শুধু অভিযোগ করেই থেমে থাকতে চান না, বরং আন্তর্জাতিক তদন্ত ও স্বচ্ছ জবাবদিহির দাবি তুলতেই এই কর্মসূচি।
বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শহীদ শরীফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড ইতোমধ্যেই ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। দেশের ভেতরে যেমন প্রতিবাদ ও শোকের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তেমনি দেশের বাইরেও এই ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন ও গোষ্ঠী প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। শিখ সম্প্রদায়ের এই ঘোষিত কর্মসূচি সেই প্রতিক্রিয়ারই একটি আন্তর্জাতিক রূপ বলে মনে করছেন অনেকে।
তারা মনে করছেন, এ ধরনের কর্মসূচি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে এবং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
তবে শিখস ফর জাস্টিসের নেতারা বলছেন, তাদের লক্ষ্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো নয়, বরং তারা যাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখছেন, তার বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক জবাবদিহি নিশ্চিত করা। আজকের কর্মসূচি ঘিরে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে।
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হলেও কূটনৈতিক স্থাপনার নিরাপত্তা প্রশ্নে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে, শহীদ শরীফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে শিখ সম্প্রদায়ের এই আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ কর্মসূচি শুধু একটি বিক্ষোভ নয়, বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিতর্ক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।