নিজস্ব প্রতিনিধি:
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যুক্ত হলো বুধবার, যখন আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীকে দেশের ২৬তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বুধবার সকালে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, যার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে তার নিয়োগ কার্যকর হয়। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ আগামী ২৭ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন, কারণ ওই দিন তার বয়স ৬৭ বছর পূর্ণ হবে।
তার অবসর গ্রহণের পরদিন অর্থাৎ ২৮ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেবেন জুবায়ের রহমান চৌধুরী। দীর্ঘ বিচারিক ক্যারিয়ার, পেশাগত দক্ষতা এবং আইনের নানা শাখায় গভীর প্রজ্ঞার কারণে তার এই নিয়োগকে বিচারাঙ্গনের অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন এবং এটিকে একটি সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন।
বর্তমানে তিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারপতির দায়িত্ব পালন করছেন এবং সেখানেই তার বিচারিক প্রজ্ঞা, যুক্তিনির্ভর রায় এবং সংবিধান ও আইনের প্রতি অঙ্গীকার বারবার আলোচিত হয়েছে।
জুবায়ের রহমান চৌধুরীর আইনপেশায় পথচলা শুরু হয় আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। ১৯৮৫ সালে তিনি জজ কোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন, যা ছিল তার পেশাগত জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
দুই বছর পর ১৯৮৭ সালে তিনি দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। আইনপেশার শুরুর দিক থেকেই তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনা করেন এবং ধীরে ধীরে একজন দক্ষ ও পরিশ্রমী আইনজীবী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। দীর্ঘদিনের আইনজীবী জীবনের অভিজ্ঞতার পর ২০০৩ সালের ২৭ আগস্ট তিনি হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান, যা তার কর্মজীবনের একটি বড় মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।
অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বিভিন্ন সংবিধানিক, প্রশাসনিক ও নাগরিক অধিকার-সংক্রান্ত মামলায় গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও রায় প্রদান করেন। দুই বছর পর, তার দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ হাইকোর্ট বিভাগে তার নিয়োগ স্থায়ী করা হয়। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে তিনি হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রশ্নে তার অবস্থান বিচারাঙ্গনে সুপরিচিত হয়ে ওঠে।
তার বিচারিক দর্শনে যুক্তি, ন্যায়বোধ এবং সংবিধানের মৌলিক চেতনাকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট ছিল, যা তাকে সহকর্মী বিচারপতি ও আইনজীবীদের মধ্যে আলাদা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। ২০২৪ সালের ১২ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন তাকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন, যা তার দীর্ঘ বিচারিক জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আপিল বিভাগে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি দেশের বিচার ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরে নানা গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তিতে অংশ নেন।
সংবিধান ব্যাখ্যা, রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বৈধতা এবং নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে তার রায় ও মতামত আইনি অঙ্গনে গভীরভাবে আলোচিত হয়। শিক্ষাজীবনের দিক থেকেও জুবায়ের রহমান চৌধুরীর রয়েছে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় পটভূমি।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি অনার্স ও এলএলএম ডিগ্রি অর্জন করেন, যা তাকে দেশের অন্যতম প্রাচীন ও মর্যাদাপূর্ণ বিদ্যাপীঠের একজন কৃতী শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচিত করে। উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ থেকে তিনি পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যে গমন করেন এবং সেখানে আন্তর্জাতিক আইনের ওপর আরও একটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
আন্তর্জাতিক আইনের এই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা তার বিচারিক চিন্তাভাবনায় একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করেছে বলে মনে করেন অনেক আইন বিশ্লেষক। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার মতো বিষয়ে তার উপলব্ধি ও বিশ্লেষণ এই শিক্ষারই প্রতিফলন। নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে জুবায়ের রহমান চৌধুরীর সামনে এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশা।
দেশের বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা, মামলার দীর্ঘসূত্রতা নিরসন, নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং জনগণের আস্থা পুনর্গঠন—এসব বিষয় নতুন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে নতুন করে গুরুত্ব পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিচারাঙ্গনের অনেকেই মনে করছেন, তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও পেশাগত সততা বিচার বিভাগকে আরও কার্যকর ও গতিশীল করতে সহায়ক হবে।
একই সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে সংবিধানের শাসন, আইনের সমতা এবং মানবাধিকারের সুরক্ষার প্রশ্নে তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নিয়োগ এমন এক সময়ে এলো, যখন দেশের বিচার ব্যবস্থা নানা কাঠামোগত ও বাস্তব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
মামলার জট, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, প্রযুক্তির ব্যবহার, ডিজিটাল কোর্ট ব্যবস্থার প্রসার এবং বিচারকদের দক্ষতা উন্নয়নের মতো বিষয়গুলো আগামী দিনে তার নেতৃত্বে অগ্রাধিকার পেতে পারে। আইনজীবী ও বিচার সংশ্লিষ্ট মহলের প্রত্যাশা, তিনি তার দায়িত্ব পালনকালে বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আরও শক্তিশালী করবেন এবং সাধারণ মানুষের কাছে বিচার বিভাগকে আরও সহজলভ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবেন।
একই সঙ্গে তার নিয়োগকে কেন্দ্র করে আইন অঙ্গনে যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, পেশাগত মান এবং সাংবিধানিক মূল্যবোধ রক্ষায় তিনি একটি ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন বলে অনেকেই আশা করছেন।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের ২৬তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নিয়োগ শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি দেশের বিচার ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা আগামী দিনে বিচারাঙ্গনের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।