নিজস্ব প্রতিনিধি:
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে যখন দলীয় মনোনয়ন, জোটগত সমঝোতা ও প্রার্থী চূড়ান্তকরণ নিয়ে তীব্র আলোড়ন চলছে, ঠিক সেই প্রেক্ষাপটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসন থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা সামনে এসেছে।
বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও দলটির কেন্দ্রীয় সহ–আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন, যা শুধু ওই আসনের নয় বরং জাতীয় রাজনীতিতেও নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বুধবার ২৪ ডিসেম্বর দুপুর সোয়া ১টার দিকে সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে তার পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন সরাইল উপজেলা যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আলী হোসেন।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রুমিন ফারহানা আগেই যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, অর্থাৎ দলীয় মনোনয়ন না পেলেও তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসন থেকেই নির্বাচনে অংশ নেবেন, তার বাস্তবায়নের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিক ধাপ সম্পন্ন হলো।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপির মতো বড় একটি দলের একজন পরিচিত মুখ ও সাবেক সংসদ সদস্যের এভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী মাঠে নামা শুধু স্থানীয় পর্যায়ে নয় বরং দলীয় রাজনীতির ভেতরেও একাধিক বার্তা বহন করছে।
গত কয়েকদিন ধরেই রুমিন ফারহানা বিভিন্ন সভা–সমাবেশ ও মতবিনিময় অনুষ্ঠানে স্পষ্ট করে জানিয়ে আসছিলেন যে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসন থেকে সরে দাঁড়াবেন না এবং দলীয় সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার লড়াই চালিয়ে যাবেন।
গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি সরাসরি বলেন, মার্কা যা–ই হোক, সরাইল–আশুগঞ্জ থেকেই তিনি নির্বাচন করবেন, কারণ এই এলাকার মানুষের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে এবং ভোটারদের প্রতি তার দায়বদ্ধতা রয়েছে।
এই বক্তব্যের পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর আলোচনা শুরু হয় যে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাচ্ছেন, আর বুধবারের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ সেই আলোচনাকে বাস্তব রূপ দিল। এর আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে রুমিন ফারহানা জানিয়েছিলেন, বিএনপি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে জোটগত সমঝোতার কারণে তিনি এ আসনে দলীয় মনোনয়ন পাননি।
তার ভাষায়, জোটগত রাজনীতিতে অনেক সময় ব্যক্তিগত যোগ্যতা, জনপ্রিয়তা বা অতীতের অবদান সত্ত্বেও আসন ছাড় দিতে হয় এবং তিনিও সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। তবে একই সঙ্গে তিনি এটাও বলেন যে তিনি দলীয় শৃঙ্খলা ও সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান রেখেই নিজের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করছেন এবং প্রয়োজনে আগাম পদত্যাগের বিষয়েও ভাবছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তার এই বক্তব্য বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটি স্পষ্ট ও সাহসী বার্তা বহন করে, কারণ সাধারণত দলীয় মনোনয়ন না পেলে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারা প্রকাশ্যে ভিন্ন অবস্থান নিতে দ্বিধা করেন।
রুমিন ফারহানার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পরপরই তিনি দ্রুত সেটি জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং নির্বাচনী প্রচারণা জোরদার করতে ইতোমধ্যেই নির্বাচনী অফিস স্থাপন, স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় এবং ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর কৌশল নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন।
তার পরিকল্পনায় রয়েছে ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা, উঠান বৈঠক আয়োজন করা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে প্রচারণার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, তার রাজনৈতিক পরিচিতি, সংসদে অতীতের ভূমিকা এবং টেলিভিশন টকশোতে সরব উপস্থিতি তাকে সাধারণ ভোটারদের কাছে একটি পরিচিত মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তার জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন বাংলাদেশ জমিয়তে উলামার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, বিষয়টি মঙ্গলবার ২৩ ডিসেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিশ্চিত করেন।
ফলে একই রাজনৈতিক ঘরানার ভোটব্যাংক একাধিক প্রার্থীর মধ্যে বিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা নির্বাচনী সমীকরণকে আরও জটিল করে তুলছে। বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা চার লাখ নিরানব্বই হাজার চারশ আটচল্লিশ জন এবং এই বিপুল ভোটারের সমর্থন আদায় করতে প্রতিটি প্রার্থীকে কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, রুমিন ফারহানার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নামা এই আসনে ভোটের হিসাব–নিকাশে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং এটি শুধু জোটের প্রার্থীর জন্য নয় বরং অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জন্যও নতুন কৌশল নির্ধারণের প্রয়োজন তৈরি করবে।
একই সঙ্গে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই ঘটনা বিএনপির ভেতরে ভবিষ্যতে দলীয় মনোনয়ন ও জোট রাজনীতির ধরন নিয়ে নতুন করে আলোচনা উসকে দিতে পারে। কারণ একদিকে দলীয় সিদ্ধান্ত, অন্যদিকে জনপ্রিয় ও পরিচিত নেতাদের স্বতন্ত্র অবস্থান—এই দ্বন্দ্ব আগামী দিনে দলীয় রাজনীতির কাঠামো ও কৌশলে প্রভাব ফেলতে পারে।
সব মিলিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসনে রুমিন ফারহানার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ শুধু একটি আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী পদক্ষেপ নয় বরং এটি দেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, জোট রাজনীতি এবং ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।