২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৫ই রজব, ১৪৪৭ হিজরি

জামায়াত এবং বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় এনসিপি

নিজস্ব প্রতিনিধি:

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তরুণদের নেতৃত্বাধীন নতুন রাজনৈতিক শক্তি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন জাতীয় রাজনীতির অন্যতম আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে এবং দলটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে জোট–সমীকরণের নতুন সম্ভাবনা ও কৌশলগত আলোচনার এক জটিল বাস্তবতা।

বিপ্লবী জুলাই আন্দোলনের ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত এনসিপিকে আগামী সংসদে প্রতিনিধিত্ব করাতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী উভয় পক্ষই দলে টানতে আগ্রহী, আর সে কারণেই নির্বাচনকে ঘিরে এনসিপির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ও ত্রিমুখী নানা ধরনের রাজনৈতিক আলোচনা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে চলেছে।

রাজনৈতিক সূত্রগুলোর দাবি, এনসিপির লক্ষ্য মূলত আগামী জাতীয় সংসদে জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং সেই লক্ষ্যে বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়ে তারা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা চালালেও একইসঙ্গে জামায়াতের সঙ্গেও যোগাযোগ বজায় রেখে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করছে, যাতে শেষ মুহূর্তে যে কোনো বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের অবস্থান মিলিয়ে নেওয়া যায়।

জানা গেছে, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এনসিপিকে কাছে টেনে নেওয়া বিএনপি ও জামায়াত উভয়ের জন্যই নির্বাচনী মাঠে একটি বড় কৌশলগত সুবিধা এনে দিতে পারে, কারণ বিপ্লবী শক্তির সমর্থন দেখাতে পারলে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে ইতিবাচক বার্তা যাবে এবং বিরোধী রাজনীতির প্রতি আস্থা আরও দৃঢ় হবে।

তবে এনসিপি নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান ও আদর্শের জায়গা থেকে হিসাব–নিকাশ করে প্রতিটি পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তারা কোনো তড়িঘড়ো বা আবেগের ভিত্তিতে নয়, বরং বাস্তবতা ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেবে। বিভিন্ন নেতার বক্তব্যে জানা যায়, বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়ে আলোচনা ইতোমধ্যে অগ্রগতি পেয়েছে এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফেরার পর এই আলোচনা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে যেতে পারে।

যদি এ আলোচনায় ইতিবাচক সাড়া মেলে তবে জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার আলোচনা ‘প্রাকৃতিকভাবেই’ থেমে যেতে পারে, তবে বিপরীতে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা ভেস্তে গেলে জামায়াত–কেন্দ্রিক সমঝোতাই তাদের বিকল্প হতে পারে—এমন ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে এনসিপির অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান যে, শুধু এনসিপি নয়, আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই আলোচনা চলছে এবং সবাইকে নিয়ে একটি সমন্বিত নির্বাচনী কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করছে বিএনপি, তবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার মতো পর্যায়ে এখনো পৌঁছানো হয়নি।

অপরদিকে, এনসিপির এক যুগ্ম আহ্বায়ক গণমাধ্যমে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দলটি নীতিগতভাবে কোনো পক্ষের সঙ্গে জোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত করেনি এবং পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক পথরেখা নির্ধারণ করা হবে। তার ভাষায়, এনসিপির লক্ষ্য কেবল আসন পাওয়া নয়, বরং আগামী সংসদে বিপ্লবী শক্তির কার্যকর উপস্থিতি নিশ্চিত করা, যাতে সংসদের ভেতর ও বাইরে সমান্তরালভাবে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারা জারি রাখা যায়।

রাজনৈতিক লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান আরিফুল ইসলাম আদীবও বলেন, বিএনপি বা জামায়াত—কোনো পক্ষের সঙ্গেই এখনো আনুষ্ঠানিক সমঝোতা হয়নি এবং ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ২০ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় রয়েছে।

এনসিপির নেতারা মনে করেন, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিপ্লবী তরুণদের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বড় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, বিশেষ করে শহীদ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ড এবং জুলাই শক্তির ওপর ধারাবাহিক হুমকির প্রেক্ষাপটে একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক অবস্থান এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাদের ভাষায়, আধিপত্যবাদী রাজনীতির চক্র ভাঙতে হলে সংসদের ভেতরে বিপ্লবী কণ্ঠস্বর থাকা জরুরি এবং এজন্যই তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণকে একটি কৌশলগত লড়াই হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক সংস্কার জোটের সম্ভাব্য কয়েকজন প্রার্থী জানিয়েছেন যে, বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা হলে তাদের নির্বাচনী অবস্থান আরও শক্তিশালী হতে পারে, বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিদ্রোহী প্রার্থীর ঝুঁকি কমে আসবে। তবে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হলে স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থীর চ্যালেঞ্জ রয়ে যেতে পারে, যেখানে জামায়াতের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে সমন্বয় সহজ বলে অনেকে মনে করেন।

রাজনৈতিক অঙ্গনের একাধিক সূত্র বলছে, গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট আরও কয়েকটি দলকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং চলতি সপ্তাহেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে। একইসঙ্গে জোটের প্রার্থীরা নিবন্ধিত এনসিপির ‘শাপলা কলি’ প্রতীক বা এবি পার্টির ‘ঈগল’ প্রতীকের যেকোনো একটি প্রতীকের অধীনে একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে নামতে পারেন—এমন সম্ভাবনাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে।

জোটের সমন্বিত ইশতেহার প্রণয়ন, প্রার্থী বাছাই, ব্র্যান্ডিং ও প্রচার কৌশল তৈরির লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দুটি পৃথক উপকমিটি গঠন করা হয়েছে, যা আগামী নির্বাচনী লড়াইকে কাঠামোগত রূপ দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু জানিয়েছেন যে, জোট নেতারা জরুরি বৈঠকে মিলিত হয়ে সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছেন এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে প্রতিটি দিক গভীরভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের এক নেতা বলেন, জোটে আরও কিছু রাজনৈতিক দল যুক্ত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে এবং যে কোনো সময় আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে। ইতোমধ্যে এনসিপি প্রথম ধাপে ১২৫টি আসনে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে এবং দ্বিতীয় ধাপে আরও ৪০–৫০টি আসনে প্রার্থী তালিকা প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে।

অপরদিকে এবি পার্টি ১০৯টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে এবং গণতন্ত্র মঞ্চের প্রার্থী তালিকায়ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রার্থী রয়েছে, যার মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের ৩০ জনকে নিয়ে নতুন জোট কাঠামোয় তা ৪০–৫০–এ উন্নীত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সব মিলিয়ে, এনসিপিকে ঘিরে তৈরি হওয়া জোট–রাজনীতির এই নতুন সমীকরণ শুধু আসন ভাগাভাগির হিসাব নয়, বরং আগামী সংসদে বিপ্লবী তরুণ নেতৃত্বের রাজনৈতিক উপস্থিতি নিশ্চিত করার কৌশলগত লড়াই, যা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাজনৈতিক চিত্রকে নতুন মাত্রা দেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top