২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৭ই রজব, ১৪৪৭ হিজরি

ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা বৃদ্ধি—মুসলিম, খ্রিষ্টান ও দলিতদের লক্ষ্য করে ধারাবাহিক হামলা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

ভারতে মুসলিম, খ্রিষ্টান ও দলিত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে একাধিক রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী হামলায় এক মুসলিম শিক্ষকসহ দুই মুসলিম ও এক দলিত নিহত হয়েছেন। একই সময়ে বড়দিন উপলক্ষে খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাধা, হেনস্তা ও সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। কর্ণাটকের একটি চার্চে যাজকের ওপর হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এসব ঘটনার ভয়াবহতাকে আরও স্পষ্ট করেছে।

বিশ্লেষকদের দাবি, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর গত এক দশকে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে। মানবাধিকারকর্মীদের মতে, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও উগ্র বক্তব্য রাজপথে সহিংসতার পরিবেশ তৈরি করছে। তাদের ভাষায়, ‘মাইনরিটি কার্ড’ এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে প্রতিযোগিতামূলকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক কাশ্মীরি রাজনৈতিক কর্মী ডা. মুজ্জাম্মিল আইয়ুব ঠাকুর বলেন, ভারতের রাজনৈতিক বাস্তবতায় মুসলমানদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, আর কাশ্মীর প্রশ্নে সেই বিদ্বেষ আরও তীব্র হয়েছে। তার ভাষায়, কাশ্মীরকে দীর্ঘ সময় ধরে একটি “পরীক্ষাগার” হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যার প্রভাব মূল ভূখণ্ডেও পড়েছে।

বড়দিন ঘিরে খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা

ভারতের ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্স জানিয়েছে, বড়দিনের মৌসুমকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন স্থানে খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় সমাবেশে বাধা ও হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ওপেন ডোরস বলছে, বড়দিনের সময় শুধু ডিসেম্বরেই খ্রিষ্টানদের ওপর ৬০টির বেশি হামলার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা ও দিল্লিতে হেনস্তা ও হামলার একাধিক ঘটনার ভিডিও প্রকাশ্যে আসে। ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান ফোরামের তথ্যমতে, চলতি বছর জুড়ে খ্রিষ্টানদের ওপর অন্তত ৬০০টি সহিংস ঘটনার অভিযোগ রয়েছে।

মুসলিম ও দলিতদের ওপর সহিংসতা অব্যাহত

একই সময়ে উত্তর প্রদেশ, বিহার, কেরালা ও ওড়িশায় মুসলিম ও দলিত নাগরিকদের ওপর হামলার ঘটনায় কয়েকজন নিহত হয়েছেন। আলিগড়ে এক মুসলিম শিক্ষককে গুলি করে হত্যা, বিহারে এক ফেরিওয়ালার মৃত্যু এবং কেরালায় এক দলিত শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। ওড়িশায় ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের এক মুসলিম শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগও উঠেছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ‘গুরুতর ও ধারাবাহিক নিপীড়ন’ চলছে। এক প্রতিবেদনে ২০২৪–২৫ সময়ে প্রায় এক হাজার ঘৃণাভিত্তিক অপরাধের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে মুসলিম, দলিত, আদিবাসী ও খ্রিষ্টানরা প্রধান লক্ষ্যবস্তু।

বাংলাদেশ ইস্যু ও ‘মাইনরিটি কার্ড’

বিশ্লেষকদের অভিযোগ, নিজ দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রসঙ্গ বাড়লেও বাংলাদেশে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেই ভারতের কিছু রাজনৈতিক শক্তি তা রাজনৈতিক প্রচারণায় ব্যবহার করছে। সীমান্ত এলাকায় প্রতীকী অবরোধ, বিক্ষোভ এবং উসকানিমূলক বক্তব্যকে সেই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাদের মতে, কিছু ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে পুরোনো ও বিভ্রান্তিকর ভিডিও প্রচার করে সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক শেখ ওমরের ভাষায়, সংখ্যালঘু প্রসঙ্গকে মানবাধিকার উদ্বেগ হিসেবে তুলে ধরা হলেও একই সময়ে ভারতের ভেতরে চলমান বৈষম্য ও সহিংসতা নিয়ে সমপর্যায়ের আত্মসমালোচনা দেখা যায় না—এ নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে।

তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্টালিনও সাম্প্রতিক সহিংসতার প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপির সমালোচনা করে বলেন, উগ্র গোষ্ঠীগুলোর হামলার মাঝেও সরকারের নীরবতা “ভুল বার্তা” দিচ্ছে।

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top