রবিউল ইসলাম বাবুল, রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধিঃ
টানা ৫ দিন ধরে সূর্যের দেখা মিলেনি উত্তর জনপদের জেলা লালমনিরহাটের কোথাও। ঘন কুয়াশা আর প্রচণ্ড ঠান্ডায় মুখ থুবড়ে পরেছে লালমনিরহাট জেলার হতদরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের জনজীবন।
দেশের উত্তর জনপদের সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাট। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত হওয়ায় দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে প্রতিবছর এ জেলায় তীব্র কুয়াশা আর কনকনে ঠান্ডা বেশি পড়ে। তারি প্রভাবে গত দুদিন দিন ধরে সূর্যের দেখা না মেলায় শীতের তীব্রতা আরো প্রচন্ড আকারে বেড়েছে। এতে খেটে-খাওয়া অসহায়, দিন মজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা চরম বিপাকে পড়েছে। এ অবস্থায় তারা কনকনে ঠান্ডা শীত থেকে রক্ষার জন্য আগুন জ্বালিয়ে ঠান্ডা নিবারণের চেষ্টা করছেন।
সোমবার (২৯ ডিসেম্বর ) লালমনিরহাট জেলার পাঁচ উপজেলার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।
দিনে রাতে ঘন কুয়াশা এবং হিমেল হাওয়ায় জনজীবন নাকাল হয়ে পড়েছে। কুয়াশা ও পশ্চিমা বাতাসের কারণে বোরো বীজতলা ও আলুর আবাদ নিয়ে কৃষকরা চিন্তিত হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে কৃষি দপ্তরের সংশ্লিষ্ট উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় রবি মৌসুমে রবি শস্যর ঠান্ডা জনতি বালাই নিয়ে বিপাকে পরেছে কৃষক। কনকনে ঠান্ডার কারণে দরিদ্র শীতার্ত মানুষের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে ।
এদিকে জেলার সদর হাসপাতাল-সহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে বাড়ছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। অন্যদিকে শীতবস্ত্রের অভাবে কষ্টে পড়েছে তিস্তা পাড়ের অসহায় নদীভাঙ্গা হতদরিদ্র ছিন্নমূল ও স্বল্প আয়ের কর্মজীবী মানুষ। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাহিরে বেরোচ্ছেন না। কনকনে ঠান্ডা শীতের দাপটে শহর ও গ্রামাঞ্চলসহ চর এলাকার বহু দরিদ্র অসহায় মানুষ আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে,জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে লালমনিরহাটে শীতের দাপট আরও বেশি অনুভূত হতে পারে। গত দুই দিনে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। লালমনিরহাটসহ আশপাশের এলাকায় তাপমাত্রা ১৫ কোঠায় না নামলেও কনকনে ঠান্ডা ও শীতে কাহিল হয়ে পড়েছে জন-জীবন। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ীর বাহিরে বের হচ্ছেন না।
এদিকে তীব্র ও ঠান্ডা শীতের কারণে নিম্ন আয়ের খেটে-খাওয়া মানুষগুলোর কাজের অভাব দেখা দিয়েছে। খেটে-খাওয়া মানুষেরা ঠিকমত নিজেদের শ্রম বিক্রি করতে না পেরে বেকায়দায় পড়েছেন তারা। ঘন কুয়াশা ও কনকনে ঠান্ডার কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ক্রেতা-বিক্রেতাও কমে গেছে।রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচল করছে ধীর গতিতে। দূরপাল্লার যানবাহনগুলো দিনের বেলা হেড লাইট জ্বালিয়ে চলতে হচ্ছে দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়ে।
শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছিন্নমূল মানুষ ও খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগের সীমা নেই। সকালে সদর উপজেলার রাজপুর ইউনিয়নের আটো রিকশা চালক নয়ন মিয়ার সঙ্গে আলোচনা হলে তিনি বলেন, যে ঠান্ডা শীত এখন বেলা ১২টা বাজে এ পর্যন্ত কোনো যাত্রী পেলাম না। রিকশা চালিয়ে টাকা আয় করতে না পারলে আজ আমার পরিবার না খেয়ে থাকবে।
পাটগ্রামের উপজেলার পাথর ভাঙ্গা কাজের শ্রমিক হাফিজ মিয়া জানান, ঠান্ডায় হাত পা শীতল হয়ে আসছে পাথরের ঝুড়ি মাথায় তুলতে কষ্ট হচ্ছে। কনকনে শীতে পাডে হেঁটে পাথরের ডালি নিতে কষ্ট হয়। আজ পাথর শ্রমিক অর্ধেক ও কাজে আসেনি।
বুড়ীমারী এলাকার ব্যবসায়ী বলেন দু- দিন থেকে ঠান্ডা খুববেশী অনুভব হচ্ছে। দিন দিন কুয়াশার সঙ্গে ঠান্ডার মাত্রা বেশি হচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকেই উত্তরের ঠান্ডা বাতাস আর কনকনে শীতে জনজীবনে অনেকটা ভোগান্তি বেড়েছে। গরীব অসহায় দিন মজুর প্রচণ্ড ঠান্ডায় কাজে যেতে না পেরে অনেকটা দিশেহারা। শীত নিবারণের জন্য মোটা গরম কাপড় পড়তে হচ্ছে তবুও ঠান্ডা নিবারণ হচ্ছে না। সন্ধ্যা থেকেই এখন গায়ে মোটা জামা কাপড়ে পরেও শীত নিবারণ সম্ভব হয় না। রাতে ঠান্ডায় দুঃস্থ অসহায় মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। শীত বস্ত্র না থাকায় তাদের প্রতি রাতে কষ্টে কাটাতে হচ্ছে। রাতে ও সকাল হলে বাড়ির সামনে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন বয়োঃবৃদ্ধ, যুবক, শিশু শ্রমজীবী মানুষ।
হাতিবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান এলাকার কৃষক জাকের আলী বলেন, আগের থেকে অনেক বেশি ঠান্ডা পড়েছে। শীত অনেক কষ্টে আছি সকালে কাজে গেলে প্রচুর ঠান্ডা লাগে, কাজ করতে খুবই কষ্ট হয়। দিনের বেলাতে সূর্যের দেখা নাই। সন্ধ্যার পর থেকে ঠান্ডা বাড়ে। সকালে কাজে যেতে পারি না ঠান্ডায় কারণে। রাতে কনকনে ঠান্ডায় কম্বলের অভাবে ঘুমাতে পারি না।
কালীগঞ্জ উপজেলার বলাইর হাট এলাকার এক ভ্যান চালক ও একজন ব্যবসায়ীর বলেন, প্রতিদিন সকালে দোকান খুলি। এখন প্রচণ্ড ঠান্ডা, কষ্ট হলেও জীবন জীবিকার তাগিদে ব্যবসার কাজ করতে হয়। আজ আগের থেকে বেশি ঠান্ডা পড়েছে। হাত পা টন টন করছে, কাস্টমার নেই। এই ঠান্ডায় তেমন কেউ বাহিরে বের হয় না, তাই বেঁচাবিক্রি নেই। এভাবে চলতে থাকলে দোকান ব্যবসা লাটে উঠবে। ভ্যানচলক বলেন গত ৪/৫ দিনে আগে যা রোজগার করেছি তার অর্ধেক এখন হয় না। ভাড়া তেমন নেই আজ সারাদিনে এখনও কোনো ভাড়া পাইনি।
আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নর কৃষক রমজান বলেন, আজ এতবেশী ঠান্ডা পড়েছে, যে কাজে যেতে পারিনি। বাড়ীতে বাজার নেই, কি করব বুঝে উঠতে পারছিনা। তাছাড়া আদিতমারী উপজেলায তামাক চাষ বেশী হয়। ভূট্টা ও আলু সরিষা,কালাই, গম রবি মৌসুমে এসকল ফসল আর চোখে পরে না। যে দিকে তাকাবেন শুধু তামাক ক্ষেত আর তামাক ক্ষেত। এসময় তামাক ক্ষেতে কাজ করলে প্রচন্ড ঠান্ডা লাগে। তামাকের গন্ধে অনেকটা অস্বস্তি মনে হয়। তাই কাজে যেতে পারিনি।
লালমনিরহাট সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা গেছে, শীতজনিত রোগের কারণে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়েছে। কনকনে শীতে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশু ও বৃদ্ধরা। শীত জনিত কারণে শ্বাসকষ্ট জনিত বিভিন্ন রোগে বয়োবৃদ্ধ ও নিউমোনিয়া-ডায়রিয়ায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
লালমনিরহাট জেলা আবহাওয়াবিদ এর সঙ্গে মুঠোফোনে আলোচনা হলে তিনি দৈনিক আমার বাংলাদেশকে বলেন, জানুয়ারি মাসে এই অঞ্চলে আরও প্রচন্ড ঠান্ডা ও শৈত্যপ্রবাহের শঙ্কা রয়েছে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক রকিব হায়দার দৈনিক আমার বাংলাদেশ সাংবাদিকে বলেন, সরকারি বরাদ্দ এসেছে। এ পর্যন্ত আমরা লালমনিরহাট জেলার পাঁচ উপজেলায় ১৭ হাজার পিচ শীতবস্ত্র কম্বল বিতরণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন,সরকারের সহযোগিতার পাশাপাশি শীতার্ত মানুষের পাঁশে লালমনিরহাট জেলার সকল বিত্তবান ও এনজিও প্রধান, ব্যাংক, ও বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে এলে শীতার্ত মানুষগুলোর কষ্ট অনেকাংশে লাঘব হবে।