৫ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২১শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১০ই মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

অশ্রু যখন মুমিনের অস্ত্র—প্রভুর ভালোবাসায় সিক্ত হৃদয়ের নিবেদন

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

এক ফোঁটা অশ্রু, যা একান্তে প্রভুর সামনে গড়িয়ে পড়ে, তা পৃথিবীর সমস্ত অমূল্য রত্নের চেয়েও বেশি মূল্যবান। এই অশ্রু কেবল দুঃখের প্রকাশ নয়, বরং তা হলো অন্তরের গভীরতম আবেগের এক নিঃশব্দ সাক্ষ্য—একটি আত্মবিশ্বাসী আত্মসমর্পণ। মুমিনের হৃদয় যখন আল্লাহর প্রেমে সিক্ত হয়, তখন সে কান্নায় ভেঙে পড়ে, যেন তার আত্মা প্রভুর অনুগ্রহে স্নাত হয়। এই কান্নায় মিশে থাকে পাপের অনুশোচনা, থাকে আত্মসমর্পণের স্নিগ্ধ আকুতি, থাকে আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।

রাতের নীরবতায় যখন একাকী সিজদা হৃদয়ের সমস্ত ভার মুক্তি দেয়, যখন কুরআনের আয়াত মুমিনের অন্তরকে স্পর্শ করে, তখন সে নিজেকে ভুলে গিয়ে প্রভুর সামনে নিবেদিত হয়ে চোখের অশ্রুতে নিজের সকল কষ্ট উপশম করে। এই অশ্রু কোনো বাহ্যিক নাটকীয়তার নয়, বরং এটি একটি অন্তরের গভীর আবেগের অনন্ত স্রোত, যা প্রভুর প্রতি অগাধ ভালোবাসার প্রকাশ।

আল্লাহ তাআলা বলেন,
“যখন মুমিনরা তাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহ শুনে, তখন তাদের চোখ অশ্রুতে ভিজে যায় এবং তারা অবনত হয়ে পড়ে।” (সূরা আল-মায়েদা, ৫:৮৩)

এই অশ্রুতে লুকিয়ে রয়েছে এক অমুল্য শক্তি—যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কেঁদেছে, সে কখনোই জাহান্নামের আগুনের শিকার হবে না। এক ফোঁটা অশ্রু, যা একাকী রাতে প্রভুর সামনে ঝরে পড়ে, তা কিয়ামতের দিন জান্নাতের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবে।

রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
“সাত শ্রেণির মানুষ কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়া পাবে… তাদের মধ্যে একজন হলো, সেই ব্যক্তি, যে একাকী আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার চোখ বেয়ে অশ্রু প্রবাহিত হয়।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৬০)

সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন এই অশ্রুর এক অমূল্য নিদর্শন।
উমর ইবনে খাত্তাব রা. যখন সূরা ইউসুফের সেই আয়াত তিলাওয়াত করতেন,
“আমি আমার দুঃখ ও কষ্টের কথা আল্লাহর কাছে প্রকাশ করি।” (সূরা ইউসুফ, ১২:৮৬)

তখন তাঁর অশ্রু তার কণ্ঠের গভীরতাকে ছুঁয়ে মুসল্লিদের কানে পৌঁছাতো।

আর রাসূলুল্লাহ সা. যাঁর সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করা হয়েছিল, তিনিও প্রতিটি রাতে তাহাজ্জুদে এতটা কাঁদতেন যে, তাঁর দাড়ি, জামা, এমনকি সেজদার স্থানও ভিজে যেত। আয়েশা রা. যখন তাঁকে প্রশ্ন করেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ সা.! আপনার তো সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করা হয়েছে, তবুও আপনি কেন এত কাঁদেন?” তিনি বলেছিলেন, “আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হতে পারব না?” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৭৪৩)

এখানে লুকিয়ে আছে মুমিনের জন্য এক অমূল্য শিক্ষা—কান্না শুধুমাত্র পাপের ভয়ে নয়, বরং এটি কৃতজ্ঞতার এক মহাকাব্যও হতে পারে। যখন একজন মুমিন উপলব্ধি করে, তার প্রতিটি নিঃশ্বাসই আল্লাহর রহমতের দান, তখন তার চোখ ভিজে ওঠে কৃতজ্ঞতার অশ্রুতে।
কিয়ামতের দিন যখন সূর্য মাথার ওপর ভাসতে থাকবে এবং পৃথিবী সৃষ্টির সেরা বিচারকের হাতে হবে, তখন সেই মুমিনরা, যারা দুনিয়াতে একাকী রাতের আঁধারে প্রভুর স্মরণে কেঁদেছে, আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবে।

এই অশ্রু মুমিনের শক্তির মূর্ত প্রতীক তার প্রতিটি দুঃখ, বিপদ ও ক্লান্তি আল্লাহর সান্নিধ্যে শান্তিতে পরিণত হয়। তার কান্না তাকে শুদ্ধ করে, তার আত্মাকে প্রশান্তি দেয় এবং তাকে জান্নাতের পথে নিয়ে যায়।
আল্লাহ যেন আমাদেরকে তাঁর ভালোবাসায় সিক্ত করে, সেই সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যাদের চোখ থেকে ঝরে পড়ে অশ্রু—যা আখিরাতে মুক্তির আলো হয়ে জ্বলবে। আমিন!

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top