শাহেদ ইবনে ইউনুস, মুতায়াল্লীম: দারুননাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদরাসা, ঢাকা
ইসলামী চিন্তাধারার মৌলিক ভিত্তিসমূহের মধ্যে “তাকওয়া” এমন একটি অনন্য গুণ, যা ব্যক্তির আত্মা, চিন্তা, আচরণ, ও সামাজিক অবস্থানকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করে। তাকওয়া শুধু একটি তাত্ত্বিক বা ধর্মীয় পরিভাষা নয়—এটি এমন এক বাস্তবধর্মী জীবনদর্শন, যা মানুষকে আল্লাহভীতি, আত্মসংযম, নৈতিকতা ও পূর্ণ মানবতা অর্জনের পথে চালিত করে। কুরআন-হাদীসের আলোকে তাকওয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করলেই বোঝা যায়, একজন মানুষের চরিত্র, নেতৃত্ব, আচার-আচরণ, এমনকি তার ভবিষ্যৎ পরিণতি—সবকিছু নির্ধারিত হয় তাকওয়ার মাত্রা অনুযায়ী।
তাকওয়ার শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ:
‘তাকওয়া’ শব্দটি আরবি “وَقَىٰ – ইয়াকী” ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ—রক্ষা করা, নিরাপদ রাখা। ইসলামী পরিভাষায় তাকওয়া বলতে বোঝানো হয়—আল্লাহর ভয়, সচেতনতা ও তাঁর বিধিনিষেধের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্যের মাধ্যমে নিজেকে পাপ ও গোনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখা।
কুরআনে তাকওয়ার গুরুত্ব:
আল্লাহ তাআলা অসংখ্য আয়াতে তাকওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। যেমন:
“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদের একটি আত্মা থেকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা নিসা: ১)
“নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাবান সে ব্যক্তি, যে সর্বাধিক তাকওয়াবান।” (সূরা হুজুরাত: ১৩)
এই আয়াতগুলোর মর্মার্থ হলো—মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব বা সম্মানের মূল ভিত্তি বংশ, ধনসম্পদ, জ্ঞান বা প্রতিপত্তি নয়; বরং তাকওয়া।
তাকওয়া কাদের জন্য অপরিহার্য?
তাকওয়া কেবল আলেম-উলামা, ইমাম, বা খতিবদের গুণ নয়; এটি প্রত্যেক মুসলমান—ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, নেতা-শ্রমিক, ধনী-গরিব—সব মানুষের জন্য অপরিহার্য। কুরআনের ভাষায়, কুরআনের উপদেশ কেবল তাকওয়াবানদের উপকারে আসে:
“এই কিতাব—এতে কোন সন্দেহ নেই—এটি মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত।” (সূরা বাকারা: ২)
হাদীসে তাকওয়ার গুরুত্ব:
রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকওয়াকে অন্তরের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে বলেছেন:
“তাকওয়া এখানে”—এবং তিনি তাঁর বুকে ইশারা করলেন। (মুসলিম: ২৫৬৪)
অর্থাৎ তাকওয়া বাহ্যিক আচার-আচরণে নয় বরং অন্তরের গভীর অনুভূতি, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে কর্মে, কথায় ও চরিত্রে।
তাকওয়ার উপকারিতা:
১. আল্লাহর সাহায্য লাভ:
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ করে দেন।” (সূরা তালাক: ২)
২. গুনাহ মাফ ও রিজিক বৃদ্ধি:
তাকওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানুষের পাপসমূহ মাফ করেন এবং রিজিকের পথ সহজ করে দেন (তালাক: ৪-৫)।
৩. আত্মশুদ্ধি ও চারিত্রিক উৎকর্ষ:
তাকওয়া মানুষকে অহংকার, হিংসা, লোভ, কু-চিন্তা ইত্যাদি আত্মিক ব্যাধি থেকে মুক্ত করে।
৪. সমাজে শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা:
একটি তাকওয়াভিত্তিক সমাজে কেউ অন্যের হক নষ্ট করে না, প্রতারণা করে না, অন্যায়-অবিচার করে না।
তাকওয়া অর্জনের উপায়:
১. আল্লাহর পরিচয় ও গুণাবলি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন:
আল্লাহকে যত বেশি চেনা যায়, তত বেশি তাঁর ভয় অন্তরে জন্মায়।
২. নিয়মিত ইবাদত ও আত্মসমালোচনার অভ্যাস:
নামাজ, রোজা, কুরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা, সৎ সঙ্গ, অন্তর্দৃষ্টি—এসব তাকওয়া বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
৩. পাপ থেকে দূরে থাকা ও তওবার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি:
আত্মশুদ্ধির জন্য নিয়মিত তওবা ও ইস্তিগফার করতে হবে।
৪. দুনিয়ার প্রতি মোহ হ্রাস করে আখিরাতমুখী মনোভাব:
যারা আখিরাতকে সামনে রেখে জীবন পরিচালনা করে, তাদের মধ্যেই সত্যিকারের তাকওয়া বিকশিত হয়।
উপসংহার:
তাকওয়া এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যা ব্যক্তি ও সমাজকে সুদৃঢ় নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। বর্তমান সমাজে যে অনৈতিকতা, দুর্নীতি, স্বার্থপরতা ও আত্মিক অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে, তার প্রতিকারে তাকওয়ার চর্চা একমাত্র কার্যকর উপায়। ব্যক্তি যদি নিজে তাকওয়াবান হয়, তবে তার পরিবার হবে শান্তিময়; পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র—সবই উন্নত ও কল্যাণময় হতে পারে।
তাই আজকের প্রেক্ষাপটে তাকওয়া কেবল ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি নৈতিক বিপ্লবের নাম—যা প্রতিটি মানুষের, প্রতিটি সমাজের ও সমগ্র মানবতার জন্য এক অপরিহার্য চেতনা।