১লা মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৩রা জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

ঘামে লেখা গৌরবনামা ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা ও মানবতার দৃষ্টিভঙ্গি

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

সকাল যখন দিগন্তে আলো ছড়িয়ে দেয়, তখন প্রথম যে শব্দ ভেসে আসে, তা হলো হাতুড়ির শব্দ, করাতের ঘর্ষণ কিংবা জমিনে পড়া চাষির পায়ের ছাপ। এ শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এক শ্রেণির মানুষের নিঃশব্দ কবিতা—তারা শ্রমিক। ইসলামের চেতনাপটে এই শ্রমিক কেবল একজন কর্মী নয়, বরং সম্মানিত ব্যক্তি, যিনি ঘামের বিনিময়ে গড়ে তোলেন সভ্যতার কাঠামো।

ইসলামের মহান নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত অধ্যয়ন করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি নিজ হাতে কাজ করতেন। মসজিদে নববীর নির্মাণকালে তিনি কাঁধে ইট ও মাটি বহন করেছেন, কূপ খননে শ্রম দিয়েছেন। তিনি বলতেন, “তোমরা তোমাদের কর্মচারীর ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি দিয়ে দাও।” এই কথায় আছে সময় অতিক্রম করে ফেরা মানবিক মূল্যবোধের চরম প্রতিফলন।

পবিত্র কুরআনেও ঘোষণা এসেছে—
“মানুষের জন্য থাকবে কেবল তার কর্মফল।”
(সূরা নাজম: ৩৯)

এ আয়াতের মর্মবাণী পরিষ্কার: শ্রেণি নয়, পদ নয়, বংশ নয়—মানুষকে সম্মানিত করে তার কর্ম। ইসলামে শ্রম কেবল জীবিকা অর্জনের পন্থা নয়, বরং তা ইবাদতের অংশ। একজন রিকশাচালক, একজন দিনমজুর কিংবা একজন তাঁতি—তাঁদের প্রত্যেকের ঘাম ইসলামের দৃষ্টিতে একেকটি পবিত্র দান।

ইসলামী সাহিত্য এই শ্রমিকচেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে পরিশীলিত উপমা ও প্রতীকে। সুফি কবিতা থেকে শুরু করে মধ্যযুগের আরবি-ফারসি গদ্যে দেখা যায়, কুলির কাঁধের দাগ কিংবা কৃষকের হাতের খোঁচা হয়ে উঠেছে আধ্যাত্মিক সাধনার চিহ্ন। বাংলা সাহিত্যের মুসলিম কবিরাও সেই ধারার অনুসারী। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন—
“শ্রমিক সে, কাস্তে হাতে খেটে চলে দিনে রাতে,
তারই ঘামে গড়া এ ভূবন—তবু সে পড়ে প্রান্তে!”

এই অবিচার দূর করার আহ্বান ইসলাম বহু আগেই জানিয়েছে। অথচ আজও দেখা যায়, বহু শ্রমিক অধিকারহীন, মজুরি বঞ্চিত, অবহেলিত। তারা কাঁধে বইছে উন্নয়নের ভার, কিন্তু হাত পেতে ফিরছে ন্যায্যতা। এ এক করুণ বৈপরীত্য।

ইসলামী মূল্যবোধে ও সাহিত্যচেতনায় শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পায় শ্রদ্ধা, সহানুভূতি ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে। এটি কোনো দান বা করুণা নয়, বরং শ্রমিকের প্রাপ্য অধিকার। তাই প্রয়োজন ধর্মীয় নীতিকে সামাজিক বাস্তবতায় পরিণত করা—যেখানে শ্রমিক শুধু ঘামের মানুষ নয়, গর্বের মানুষ।

আজকের সমাজে যখন নানামুখী বৈষম্য ও অবমূল্যায়ন ঘিরে ফেলে শ্রমজীবী মানুষদের, তখন ইসলাম আমাদের ডাকে ফিরে যেতে সেই মৌলিক চেতনাতে—যেখানে শ্রমিক এক রূপকার, এক ত্যাগী, এক নির্মাতা। তার ঘামে গড়া পৃথিবীকে যদি আমরা শ্রদ্ধা করতে না শিখি, তবে উন্নয়ন হবে নিঃস্ব আর সভ্যতা হবে পাথর।

লেখক, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো,মিশর

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

এই বিভাগের আরও খবর

শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় একমাত্র পথ ইসলাম

লেখক: মাওলানা আসগর সালেহী মে দিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: মে দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় প্রতি বছর ১ মে। এর সূচনা ১৮৮৬ সালের

“পড়তে হবে, পড়ার মতো” – নতুন দৃষ্টিকোণ নিয়ে বই পড়ার গুরুত্ব!

আব্দুল মাবুদ মোহাম্মদ ইউসুফ, মুতায়াল্লীম: দারুননাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদরাসা, ঢাকা আজকের যুগে প্রযুক্তি ও ডিজিটাল মাধ্যমের আধিপত্য থাকা সত্ত্বেও বই পড়ার গুরুত্ব একেবারেই কমে যায়নি।

তাকওয়া: আত্মগঠনের মূল চাবিকাঠি ও সমাজকল্যাণের ভিত্তিপ্রস্তর!

শাহেদ ইবনে ইউনুস, মুতায়াল্লীম: দারুননাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদরাসা, ঢাকা ইসলামী চিন্তাধারার মৌলিক ভিত্তিসমূহের মধ্যে “তাকওয়া” এমন একটি অনন্য গুণ, যা ব্যক্তির আত্মা, চিন্তা, আচরণ, ও

Scroll to Top