আসগর সালেহী, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
চট্টগ্রামে র্যাব-৭ এর সিনিয়র এএসপি ও ৩৭তম বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা পলাশ সাহার মৃত্যু নিয়ে দেশজুড়ে চলছে ব্যাপক তোলপাড়। প্রাথমিকভাবে এটিকে ‘আত্মহত্যা’ বলা হলেও, একের পর এক তথ্য ও আলামতে উঠে আসছে রহস্যজনক ও গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস।
নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্য-
বিশ্বস্ত গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’র কাছে সীমান্ত ও চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাকস সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পাচারের অভিযোগে ASP পলাশ সাহার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত চলছিল। কয়েক মাস ধরে গোপনে তার ইমেইল, ক্লাউড স্টোরেজ এবং এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ব্যবহারের ওপর নজরদারি করা হয়। একপর্যায়ে পাওয়া যায় — তার ডিভাইস থেকে পার্শ্ববর্তী দেশের সার্ভারে স্পর্শকাতর তথ্য আদান-প্রদানের প্রমাণ।
বিশেষ করে, ২০২৩ সালে একটি সরকারি সফরে ভারতে যাওয়ার পর সহকর্মীরা ফিরে এলেও, অবকাশ যাপনের অজুহাতে পলাশ সাহা শিলংয়ে থেকে যান। সেখানকার একটি ‘স্যাটেলাইট ব্লাইন্ড স্পট’ এলাকায় একাধিক উচ্চপদস্থ ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তার সাথে তার বৈঠকের তথ্যও এসেছে গোয়েন্দা নথিতে।
বিতর্কিত যোগাযোগ এবং আগের সংশ্লিষ্টতা-
ASP পলাশ সাহা ছিলেন বিতর্কিত ডিআইজি বনজ কুমারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। যিনি চট্টগ্রামের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে আলোচিত ছিলেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই সংযোগও তদন্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা।
মৃত্যুর আলামত ও তদন্ত প্রশ্ন-
পলাশ সাহার মৃতদেহ র্যাব-৭ কার্যালয়ে তার অফিসকক্ষে চেয়ারে বসা অবস্থায় পাওয়া যায়। মাথায় গুলির আঘাত। তবে মৃত্যু পরিস্থিতি ও দেহভঙ্গি দেখে আত্মহত্যার প্রচলিত ধরনে কিছুটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
আলাদা সুইসাইড নোট-এর হাতের লেখা ও ভাষাগত কাঠামো পরীক্ষা করে পারিবারিক সদস্য এবং ব্যাচমেটরা দাবি করেছেন — এটি ASP পলাশের নিজস্ব লেখা নয়। ফরেনসিক বিশ্লেষকরা হাতের লেখার স্ট্রোক ও অক্ষরের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে ইতিমধ্যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনের চাপ-
দুই বছর আগে ফরিদপুরের এক তরুণী সুস্মিতা সাহার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পরিবারের সূত্রে জানা যায়, বিয়ের পর থেকেই পারিবারিক অশান্তি শুরু হয়। স্ত্রী প্রায়ই মাকে নিয়ে আপত্তি করতেন। মাকে বাড়ি পাঠানোর জন্য পলাশের ওপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করতেন। পলাশ ছিলেন মা-ভক্ত। স্ত্রী এবং মায়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-
১. গুলির শব্দ শোনার পর নিরাপত্তাকর্মীরা কী ব্যবস্থা নেয়? ২. সুইসাইড নোট কবে, কোথা থেকে, কার মাধ্যমে উদ্ধার হলো? ৩. গুলির ইনজুরি রিপোর্ট অনুযায়ী গুলির প্রবেশ ও বহির্গমন দিক কোনটি ছিল? ৪. মৃত্যুর সময় তার ঘনিষ্ঠ পরিসরে কে বা কারা ছিল? ৫. অফিসের সিসিটিভি ফুটেজ (যদি থাকে) কেন এখনো প্রকাশ হয়নি?
সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে জোর দাবি জানাচ্ছে: একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে, সুইসাইড নোটটির হাতের লেখা ফরেনসিক পরীক্ষা করতে হবে, অফিসকক্ষের সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করতে হবে, পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদের বক্তব্য নথিভুক্ত করতে হবে।
দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার রহস্য উন্মোচন করা এখন সময়ের দাবি। কারণ, এ ঘটনা নিছক ‘আত্মহত্যা’ নয় — এটি হয়তো কোনো উচ্চপর্যায়ের সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। যথাযথ তদন্ত ছাড়া এই মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য চাপা থাকবে এবং অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হবে।