১৩ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৮ই মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

সৈকতের নিচে শাদা ছায়া

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

কক্সবাজারের আকাশে এখনো সূর্য নামে প্রতিদিন, কিন্তু সম্প্রতি সেই আলোয় যেন এক অচেনা ছায়া পড়েছে। বালুকাবেলার ওপর যেসব পায়ের ছাপ পড়েছে সেগুলো কেবল পর্যটকের নয়—সেগুলোর মধ্যে মিশে গেছে দূর দেশের বুটজোড়ার ছাপ। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষক দল এসেছে আমাদের ফায়ার সার্ভিসকে ‘সহযোগিতা’ করতে। মুখে মানবতা, পোশাকে শৃঙ্খলা, কথায় প্রশিক্ষণ—সবকিছুই যেন নিখুঁত নাটকীয়তার মতো পরিপাটি। অথচ এই সাজের মধ্যেই ইতিহাসের অভিজ্ঞতা প্রশ্ন তোলে—এই আগমন কি নিছক প্রশিক্ষণ, নাকি গভীর কোনো কূটনৈতিক কোলাজ?

বাংলাদেশ এমন এক ভৌগোলিক গাঁটে দাঁড়িয়ে, যার প্রতিটি ইঞ্চি এখন আন্তর্জাতিক স্বার্থের গহ্বরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একদিকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি—দুই পরাশক্তির মধ্যবর্তী জলধারায় বাংলাদেশ যেন এক নিরীহ নৌকা, যা নিজের ইচ্ছায় নয়, ঢেউয়ের ইশারায় চলতে বাধ্য। এমতাবস্থায় কক্সবাজারের মতো কৌশলগত অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি নিঃসন্দেহে নিখুঁতভাবে সাজানো একটি কূটনৈতিক চাল। তারা বলে এসেছে, আমাদের প্রস্তুত করছে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য। কিন্তু ইতিহাস জানে, যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই ‘মানবিক সহায়তা’ নিয়ে পা রেখেছে, সেখানেই একদিন স্থায়ী কৌশলগত ছায়া বিস্তার করেছে।

আমরা কি ভুলে গেছি ইরাকের কথা? আফগানিস্তানে প্রথমে ত্রাণ নিয়ে গিয়ে পরে কী রেখে এসেছিল তারা? সেই অনুর্বর ভূমিতে তারা ফেলে গেছে জাহাজ, ঘাঁটি, অস্ত্র আর সর্বোপরি অস্থিরতা। আজ তারা কক্সবাজারে এসেছে রশি ও জীবাণুনাশক হাতে। কাল কী নেবে সেই জায়গায়? অস্থায়ী সহায়তা কখন স্থায়ী উপস্থিতিতে রূপ নেয়, তার প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় পাতায় রক্তে লেখা।

তবে এখানেই শেষ নয়। কক্সবাজার কোনো সাধারণ এলাকা নয়। এটি সীমান্তঘেঁষা, রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুতদের অস্থায়ী আশ্রয়স্থল, এবং বঙ্গোপসাগরের দরজায় দাঁড়ানো এক কৌশলগত রেখা। এখানে কেউ হাঁচিও দিলে তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়। আর সেখানে যদি বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামরিক শক্তি পা রাখে, সেটা কি আমরা প্রশিক্ষণ বলে মেনে নেব?

বাংলাদেশ একটি অতীব সূক্ষ্ম ক্রসফায়ারে দাঁড়িয়ে। একদিকে পূর্ব এশিয়ার আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধ, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্পর্শকাতরতা। এমন অবস্থায় নীরব থাকা মানেই আত্মসমর্পণ। প্রশ্ন তোলা মানেই দেশপ্রেম, কারণ স্বাধীনতা শুধু অতীতের নয়, প্রতিদিনের সংগ্রাম। তাই এই মুহূর্তে আমাদের সাহস করে প্রশ্ন তুলতেই হবে—কেন তারা এল? কাদের সঙ্গে আলোচনা করে এল? এ দেশে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার অনুমতি কারা দিল? এবং আমরা জনগণ কী জানি?

যখন একটি রাষ্ট্র তার সৈকতে পরাশক্তির পায়ের শব্দ শুনে চুপ থাকে, তখন সে রাষ্ট্র আর নিজস্ব থাকে না। আমরা যদি এখন না জেগে উঠি, যদি না বুঝি কী খেলা শুরু হয়েছে আমাদের মাটিতে, তাহলে ইতিহাস আবারও আমাদের ভুলের দায়ে দগ্ধ করবে।

এই দেশ আমরা স্বাধীন করেছি যুদ্ধ করে, সাহসের রক্তে। এখন সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হলে দরকার হবে এক অন্য রকম যুদ্ধ—বুদ্ধির, চেতনার, প্রশ্নের। প্রশিক্ষণের নামে কারা আমাদের ভূমিতে ছায়া ফেলছে, সেটাই আজ আমাদের জানতে হবে।

সৈকতের বালিতে লিখে দেওয়া হোক—বাংলাদেশ কারো ঘাঁটি হতে চায় না। আমরা বন্ধু চাই, প্রভু নয়।

লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো, মিশর

ফেসবুকে আমরা

মন্তব্য করুন

guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সর্বাাধিক পঠিত নিউজ

Scroll to Top