লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান
যখন পবিত্র কাবা শরীফের আঙিনায় লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়—“লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক”, তখন আসমান-বাতাস যেন কেঁপে ওঠে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়ার এক হৃদয়গ্রাহী দৃশ্যে। হজ শুধুমাত্র ইসলামের একটি স্তম্ভ নয়—এটি একজন মুমিনের আত্মার পরিশুদ্ধির এক মহিমান্বিত সফর।
ইসলামের দৃষ্টিতে হজ এমন একটি ইবাদত, যা মানুষের অন্তরকে পাপমুক্ত করে, চিন্তা ও চেতনায় নবজাগরণ ঘটায়। এ হজই একজন মানুষকে আল্লাহর সর্বোচ্চ নৈকট্যে পৌঁছে দেয়ার একটি ইলাহী মাধ্যম, যা অন্য কোনো ইবাদতের মাধ্যমে অর্জন সম্ভব নয়।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আর আল্লাহর জন্য মানুষের উপর হজ করা ফরজ, যারা সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে। আর কেউ যদি তা অস্বীকার করে, তবে জানুন, নিশ্চয়ই আল্লাহ দুনিয়ার কারো মুখাপেক্ষী নন।”
(সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)
এই আয়াতটি শুধু হজের বিধান নয়, বরং একজন মুমিনের প্রতি এক ঈশ্বরীয় আহ্বান। এখানে আছে দায়িত্বের ভাষা, আছে ভালোবাসার ছোঁয়া, আছে কর্তব্যের পরিপূর্ণতা।
হজের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর প্রতি একান্ত ভালোবাসা, রাসূলের স্মৃতির অনুসরণ, হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগের পুনঃপ্রতিফলন। তাই হজ শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি এক আত্মিক সোপান, যেখানে মুমিন নিজেকে বিলীন করে মহান সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে নিজেকে সমর্পণ করে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি হজ করল, অশ্লীলতা ও গুনাহ থেকে বিরত থাকল, সে যেন মায়ের গর্ভ থেকে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর ন্যায় পবিত্র হয়ে ফিরে আসে।”
(সহীহ বুখারি: ১৫২১)
এ হাদীস যেন হজের সর্বোচ্চ পুরস্কারকে তুলে ধরে—সম্পূর্ণ পাপমুক্তি, এক নতুন জীবন।
তবে হজ সবার জন্য নয়—এটি নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণকারীদের জন্য ফরজ। যেমন:
একজন মুসলমানকে হতে হবে মুসলিম, প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন, শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম এবং নিরাপদ যাত্রার উপযোগী। নারীদের ক্ষেত্রে মাহরাম পুরুষের সঙ্গে যাওয়ার শর্তও রয়েছে। এই সব শর্ত পূরণ হলে হজ অবহেলা করা এক গুরুতর গুনাহ হিসেবে গণ্য হয়।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ করল না, সে ইহুদি বা খ্রিষ্টান হয়ে মরুক, তাতে কিছু আসে যায় না।”
(সুনানে দারেমি)
এই হাদীস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় হজের গুরুত্ব কতটা গভীর, কতটা অপরিহার্য।
হজ মানে কেবল কাবা প্রদক্ষিণ নয়, এটি এক দেহ-মন-আত্মার পরিপূর্ণ পরিবর্তন। মানুষ এখানে আসে দুনিয়ার সব মোহ ও পরিচয় ঝেড়ে ফেলে, শুধু “আবদ” পরিচয়ে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে। এখানে বাদশাহ আর ফকির একই সারিতে, ধনী-গরিবের ব্যবধান বিলীন।
আরাফার ময়দান যেন মানুষের জবানবন্দির আদালত, যেখানে বান্দা স্বীকার করে তার ভুল, কান্নায় ভিজে যায় কাঁধের সাদা কাপড়, হৃদয় হয় আল্লাহর নিকটবর্তী।
হজ শেষে কেউ যখন ফিরে আসে—সে যেন শুধু নিজের জন্য নয়, বরং সমাজের জন্যও হয়ে ওঠে এক আলোকবর্তিকা। তার আচরণে, চরিত্রে, দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা দেয় পরিবর্তন—যা সমাজকে আলোকিত করে।
হজ তাই শুধুই ইবাদত নয়, এটি আত্মসংযম, সামাজিক সাম্য, এবং আধ্যাত্মিক জাগরণের এক বিপুলতর উপলক্ষ। এই ইবাদতের মাহাত্ম্য যে একবার হৃদয়ে ধারণ করেছে, তার জীবনের গতিপথ বদলে যায় অনন্ত কৃতজ্ঞতার ধারা হয়ে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে কবুল হজের তাওফিক দিন, হোক আমাদের জীবনে অন্তত একবার সেই শুভ সফরের সৌভাগ্য—যেখানে হৃদয় হারায় দুনিয়ার মোহে নয়, বরং মেলে আল্লাহর ভালোবাসার অপারতায়।
আমিন।
লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর